দেবী অন্নপূর্ণার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যেটি চোখে পড়ে, সেটি হল-লক্ষ্মী শস্যের দেবী হয়েও 'অন্নপূর্ণা' নামে অভিহিতা হতে পারলেন না। উল্টে দেবদেবীর রাজ্যে নতুন এক দেবীর আমদানি করতে হল। অথচ আমরা প্রত্যেকেই মানি যে, লক্ষ্মীর কৃপায় ভূমি শস্যশালিনী হলে তবেই অন্নের সংস্থান হয়, তবুও।
শস্যদায়িনী দেবী বলে আমরা লক্ষ্মীকে মানি বলেই মাঠে শস্য পেকে উঠলে 'ডাক' অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁর অনুমতি নিয়ে জমি থেকে শরৎ শেষে ফসল কাটি, খামারে অনি, ঝাড়াই-বাছাই করে ঘরে (গোলায়) তুলি। তারপরই হয় আমাদের অর্থাৎ আপামর বাঙালির 'নবান্ন' উৎসব।
অঘ্রানের নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে লক্ষ্মীদেবীর পুজো করে, নতুন ধানের নতুন চালের অন্ন ও পিঠে প্রথমে দেবীকে উৎসর্গ করে তবেই গেরস্ত নিজে আহার হিসেবে গ্রহণ করেন। এই উৎসব যেন দেবী লক্ষ্মীর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ও তাঁর কৃপার কথা স্মরণ করার অনুষ্ঠান।
এই যে গেরস্ত মনে করেন--দেবীর অনুগ্রহ না-থাকলে ভূমিতে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় না; তাতে সচেতনভাবে না-হলেও, অচেতনে তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, দেবী একাধারে 'শস্যদায়িনী' ও 'অন্নদায়িনী'। তাঁকে গেরস্ত বহুকাল ধরে অভিহিত করে আসছেন, 'নবান্ন-লক্ষ্মী' বা 'হেমন্ত-লক্ষ্মী' নামে। 'নবান্ন' মানেই তো, 'নতুন অন্ন'।
নতুন এই 'অন্ন'-কে গেরস্ত লক্ষ্মীর অনুগ্রহ যেমন ভাবেন, তেমনই ভাবেন দেবী লক্ষ্মীর প্রতীকও। তারই জন্য তাঁরা ধান-চাল-ভাতের মৌখিক নাম দিয়েছেন, 'লক্ষ্মী'। খাবার পাতে ভাত ফেলে উঠলে বলেন, 'লক্ষ্মী নষ্ট হল!'; আর সারাদিন আহার না-জুটলে বলেন, 'লক্ষ্মীর দানাটিও পেটে যায়নি!'
আসলে 'অন্ন' শব্দটি যে 'অদ্' ধাতু থেকে জন্ম নিয়েছে, তার অর্থই হচ্ছে, 'খাওয়া'। সেখান থেকে দেখলে, জাগতিক যা কিছু খাওয়ার যোগ্য জিনিস, সমস্তই 'অন্ন'। আমরা যে 'বায়ু সেবন' কথাটি বলি, সেবিত হয়ে সেই বায়ু-ও কিন্তু এখানে 'অন্ন'-র মর্যাদা পায়। এদিক থেকে অর্থাৎ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে শস্যদেবী হয়েও লক্ষ্মীর 'অন্নপূর্ণা' হতে বাধা ছিল না। শস্য তো 'আহার্য'-ই।
তাই এখন আমাদের বিচার্য, 'অন্নপূর্ণা' লক্ষ্মীর রূপান্তর না-হয়ে দুর্গার আর এক রূপ হলেন কেন?
'অন্ন' ছেড়ে এবার আসুন 'অন্নপূর্ণা' শব্দের দিকে এগোই। 'অন্নপূর্ণা' শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, 'যিনি অন্ন দিয়ে জগৎ পূর্ণ করেন'। এই অর্থেও তো লক্ষ্মীকে 'অন্নপূর্ণা' মনে হয়। তাহলে?
আসল কথা হচ্ছে, নবান্ন-লক্ষ্মীর পুজো হয় বর্ষায় চাষ করা ফসল অর্থাৎ খারিফ শস্য ঘরে উঠলে, অঘ্রান-পৌষ মাসে। আর, দেবী অন্নপূর্ণার পুজো হয় শীতের ফসল অর্থাৎ রবি শস্য ঘরে উঠলে, চৈত্র-বৈশাখ মাসে। তার মানে, আমরা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি যে, বাংলার ছয় ঋতুর দুই শস্য-পর্যায়ের দু'জন শস্যদায়িনী-অন্নদায়িনী দেবী রয়েছেন, নবান্ন-লক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণা।
সুতরাং পুরাণকার, শাস্ত্রজ্ঞ, স্মৃতিকার বা পুরোহিত ঘোষণা করুন আর না-ই করুন, নবান্ন-লক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণা রূপভেদে যথাক্রমে লক্ষ্মী এবং দুর্গা হলেও উদ্দেশ্যগত দিক থেকে হয় দু'জনেই লক্ষ্মী, নয় দু'জনেই অন্নপূর্ণা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্দেশ্যই যদি এক হয়, তাহলে এই রূপভেদ কেন? নামভেদ কেন? উৎসভেদ কেন?
আসল উত্তরটি লুকিয়ে আছে উদ্দেশ্যটিরই ভিন্ন দুই অভিমুখ এবং প্রেক্ষাপটের মধ্যে। সেগুলোই এখন আমরা বিশ্লেষণ করব।
আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এই যে আমাদের এত দেবদেবী, এত উৎসব, এত সংস্কার, এত আচার--এ-সবের উদ্ভবের মূলে কোন-না-কোন দিক দিয়ে কৃষি জড়িত আছে। 'অন্নপূর্ণা' দেবীর উদ্ভবের মূলেও তাই।
বৃষ্টিনির্ভর কৃষির এই দেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বর্ষাকালীন ধানের চাষ হত। উত্তর-বৈদিক ও পৌরাণিক সৌভাগ্য-সম্পদের দেবী শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী চাষাভুষোর হাতে পড়ে একদা হয়ে উঠলেন সেই ধান্যশস্যের দেবী। কারণ, তাঁদের কাছে শস্যই সম্পদ, ভালো ফলন হওয়াটাই সৌভাগ্য। অর্বাচীন পুরাণ এবং লোকপুরাণ তাঁদের সেই ভাবনাকে স্বীকৃতি দিল। লক্ষ্মী হয়ে উঠলেন লোকসমাজের আরাধ্য।
অনাবৃষ্টি না-হলে বর্ষাকালীন ধান চাষে তেমন কোন দুশ্চিন্তা থাকত না। প্রায় রাজারহালেই চাষ করা যেত। যে কাজে, যে প্রেক্ষিতে দেবীর সৃষ্টি ঘটে; দেবীর মূর্তিনির্মাণ ও সাজসজ্জাও তেমনই হয়। তাই বর্ষাপর্বের দুশ্চিন্তাহীন কৃষির দেবী লক্ষ্মীর সাজটিও হল পটেরবিবিটির মতো। তাঁর সাজসজ্জায় বাহুল্যের কমতি হল না, স্বচ্ছলতার চূড়ান্ত হল, দীনতার ছাপ রইল না। তাঁর ধ্যানমন্ত্রে রূপনির্মাণে তাই লেখা হল :
"পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।"
অৰ্থাৎ, (দেবীর চারটি হাত) উপরের ডান হাতে পাশ ও অক্ষধারিণী, বাঁ-হাতে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, নীচের বাঁ-হাতে সোনার পদ্মধারিণী, ডান হাতে বরদাত্রী, পদ্মের আসনে অবস্থিতা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা দেবীকে ধ্যান করি।
কালক্রমে যখন রবি শস্য হিসেবে ধানচাষের সূচনা হল, তখন প্রেক্ষাপটটি গেল বদলে। কখনো বৃষ্টি হত, কখনো হত না। বৃষ্টি হলে ফসল হত, নইলে মাথায় হাত। তখন ধানের ফলন এমনিতেই কম হত, যাদের জমি কম, একবার চাষ করে তাদের সম্বৎসরের অভাব মিটত না।
সুখে-দুঃখে-দুই প্রেক্ষাপটে দেব-দেবীদের জন্ম হয়। সুখের সময় যে দেব-দেবীদের সৃষ্টি করা হয়, সুখ যেন চিরকাল বজায় থাকে, সেই প্রার্থনা জানাতেই তাঁদের সৃষ্টি করা হয়। যেমন, লক্ষ্মী বা নবান্ন লক্ষ্মী। আর দুঃখের সময় যে দেব-দেবীদের সৃষ্টি করা হয়, তাঁরা যাতে দুঃখ ঘোচাতে সক্রিয় ভূমিকা নেন, সেই জন্যই সৃষ্টি করা হয়।
ফলে গেরস্ত ভাবলেন যে, রবি-শস্যের দুশ্চিন্তা আপাদমস্তক রাজরানির মতো সুখী সুখী দেখতে দেবী লক্ষ্মীকে দিয়ে দূর হবে না। তার জন্য অন্য এক দেবীর প্রয়োজন। যে দেবী লক্ষ্মীর মতো সন্তানহীনা নন, শুধু স্বামীটি আর সংসারটি নিয়ে বাঁচেন না; যাঁর মধ্যে প্রবল মাতৃত্ব আছে, যাঁর অনেকগুলো ছেলেপুলে আছে, যাঁকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে অন্ন তুলে দিতে হয়--তেমন দেবীর প্রয়োজন। তেমন কে আছেন দেবলোকে?
দেব-দেবীদের ইতিমধ্যে পুরাণের স্বর্গলোক থেকে পৃথ্বীলোকে গাঁ-গঞ্জের মাটিতে নামিয়ে আনা শুরু হয়ে গেছে মঙ্গলকাব্যের ধারাস্রোত বেয়ে। তৈরি হতে শুরু করেছে, লোকপুরাণ। মুখে মুখে। শিব সপরিবারে চাষি হয়ে নেমে এসেছেন গাঁয়ের মাঠে। চাষ করছেন, ভিক্ষে করছেন। অভাবের মুখোমুখি হচ্ছেন। আর তাঁর সেই কষ্টের সংসার পোলাপানদের কোলে-কাঁখে নিয়ে গাঁয়ের গিন্নিবান্নির মতোই সামলাচ্ছেন পার্বতী।
ব্যস, মিলে গেল। গেরস্ত যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই পার্বতী। এমন মাটি ঘেঁষা আটপৌরে দেবীই তো চাই। যিনি শুধু পদ্মাসনে বসে পুজো নেবেন না, ভক্তের থালায় নিজের হাতে খাবার বেড়ে দেবেন।
ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে গেল দেবীর মানস প্রতিমা। দেবী কারও ভাবনায় লক্ষ্মীর মতোই চতুর্ভুজা হলেন, কারও ভাবনায় দ্বিভুজা।
দ্বিভুজা দেবীই সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেন। তাঁর এক হাতে অন্নের থালা, অন্য হাতে খাবার বেড়ে দেবার হাতা। উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে লোকসাধারণ দেবীর নাম দিলেন, 'অন্নপূর্ণা'। কারণ, এই সেই দেবী, যিনি সাক্ষাৎ অন্ন দিয়ে জগৎ পূর্ণ করবেন। যাঁর কাছে এই লোকসাধারণ প্রার্থনা জানাবেন, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে'!
রচিত হল দেবীর ধ্যানমূর্তি, ধ্যানমন্ত্র :
"রক্তাং বিচিত্র-বসনাং নবচন্দ্রচূড়াম-
অন্নপ্রদাননিরতাং স্তনভারনম্রাম্।
নৃত্যন্তমিন্দুশকলাভরণং বিলোক্য
হৃষ্টাং ভজে ভগবতীং ভবদুঃখহন্ত্রীম্॥
অর্থাৎ, 'দেবী রক্তবর্ণা। তাঁর অঙ্গে বিচিত্র ভূষণ, কপালে আধখানা চাঁদ। নৃত্যভঙ্গির মধ্য দিয়ে তিনি অন্ন দান করছেন। স্তনের ভারে তাঁর দেহ নুয়ে পড়েছে। (শিব তাঁর ডান দিকে দাঁড়িয়ে দত্ত অন্ন গ্রহন করছেন)। শিবকে দেখে দেবী উৎফুল্ল হচ্ছেন। জগতের দুঃখহারিণী এই দেবীকে ভজনা করি।'
এবার আসুন এই মন্ত্রটি বিশ্লেষণ করি :
দেবী রক্তবর্ণা। কারণ, প্রাচীন কৃষিভাবনায় রক্ত উর্বরতার প্রতীক। ভূমিতে পশুবলি দেওয়া হত জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য। এই বিষয়টিকে প্রতীকায়িত করার জন্যই হয়ত মন্ত্রস্রষ্টা বা দেবীর মানসমূর্তি নির্মাতারা দেবীর গায়ের রঙ হিসেবে রক্তের রঙটিকে বেছে নিয়েছিলেন।
শিবের মাথায় আধখানা চাঁদ। দেবীর মাথায় বাকি অর্ধেক। এটা যেন দেবীর প্রকৃত অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার প্রবণতাকেই ব্যক্ত করছে। তাছাড়া, সতীকে হারিয়ে শিব যখন উন্মাদ, তখন মাথা ঠাণ্ডা করতে চাঁদ তাঁর শিরভূষণ হন। তাই অভাবের সংসারে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সবকিছু সামলে নেওয়ার প্রতীক হিসেবেও চাঁদ অন্নপূর্ণার মাথার ভূষণ হয়ে থাকতে পারেন।
মাথা ঠাণ্ডা রেখে সংসার সামলাচ্ছেন বলেই দেবীর ভঙ্গিতে নৃত্যের ছোঁয়া, স্বামী ও জগতের সামনে দারিদ্র্যকে লুকোচ্ছেন বলেই তাঁর অঙ্গে বিচিত্রভূষণ।
দেবীর স্তনভার সমৃদ্ধির প্রতীক। অনাবৃষ্টির ঋতুচক্রে জলপূর্ণ মেঘের প্রতীক। আবার সাংসারিক দৃষ্টিকোণে, সংসার-অভিজ্ঞা গিন্নির দেহরেখার সঙ্গে মানানসই।
দেবী সন্তান ও স্বামী-সোহাগী বলেই শিবের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হচ্ছেন, জানান দিচ্ছেন যে, ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত অভাব, সমস্ত দুঃখ তিনি ঘুচিয়ে দেবেন।
এবার শেষ করার পালা। পরিশেষে বলি যে, পার্বতীর সাংসারিক গুণগুলো লক্ষ্মীর মধ্যে নেই বলেই লক্ষ্মী সমৃদ্ধির দেবী হলেন, সৌভাগ্যের দেবী হলেন, শস্যের দেবী হলেন, অন্নের দেবী হলেন; কিন্তু, 'অন্নপূর্ণা' হতে পারলেন না।