'দশহরা'র উৎসকথা ও পৌরাণিক উপাখ্যান

আজ দশহরা। কিন্তু, 'দশহরা' কী?


'দশহরা' শব্দবন্ধটি গড়ে উঠেছে আসলে দুটি কথার সমাহারে। 'দশ' অর্থাৎ 'দশটি' এবং 'হরা' অর্থাৎ 'হরণকারী'। তার মানে, যে-দিনটি দশটি হরণ করে, তা-ই 'দশহরা'। 


কিন্তু, কী হরণ করে?


পাপ।


কীভাবে?


এ-বিষয়ে সুধীরচন্দ্র সরকার তাঁর 'পৌরাণিক অভিধান'-এ লিখছেন: "জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লাদশমীতে মঙ্গলবারে হস্তানক্ষত্রে গঙ্গা স্বর্গ হতে মর্তলোকে আসেন; সেই জন্য এই দিন অত্যন্ত পবিত্র ও পুণ্য। এই তিথি নানারকম পাপ ক্ষয় করে এবং এই তিথিতে স্নান ও দান করলে বাজিমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। এই তিথিতে গঙ্গা দশবিধ পাপ ও দশজন্মার্জিত পাপ হরণ করেন বলে এর নাম দশহরা।" উল্লেখ্য যে, 'বাজিমেধ যজ্ঞ' মানে, অশ্বমেধ যজ্ঞ।


'দশহরা' দিনটির সূচনা কীভাবে হল?


এ-প্রসঙ্গে 'বিষ্ণু পুরাণ' কী বলছেন, আসুন একবার শুনে নিই:


'বিষ্ণু পুরাণ'-এ কল্পনা করা হয়েছে, ধ্রুবতারাকে মাঝখানে রেখে যে-নক্ষত্রমালা রয়েছে, তাদের মেঘপুঞ্জ নাকি বিষ্ণুর তৃতীয় পা। কোন-এক-কালে সেই পা বা মেঘ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিরূপে ঝরে পড়ে হিমালয়ের মাথায়। যে-দিন ঝরে পড়ে, সে-দিনটা ছিল 'অক্ষয় তৃতীয়া'। তারপর সেই ধারাপাত স্রোতের আকার নিয়ে যে-দিন পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছল, সেই দিনটার নাম দেওয়া হল, 'দশহরা'।

gangaDashohara1

বেশ, 'দশহরা' বুঝলাম। এ-দিন গঙ্গার প্রথম মর্তলোকে অবতরণ বুঝলাম। কিন্তু, গঙ্গা হঠাৎ মর্তে কেন অবতরণ করতে গেলেন, সেটা তো বুঝলাম না!

সেটা বুঝতে, 'গঙ্গা' সম্পর্কে আগে ছোট্ট একটু বৈদিক-পৌরাণিক ভূমিকা শুনব। তারপর শুনব সহজ একটি পৌরাণিক গল্প। আসুন, শুনি:


গঙ্গা বেশ প্রাচীন নদী। কেননা, হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ 'ঋক' বেদে নদীরূপে ও দেবীরূপে 'গঙ্গা' উল্লিখিত রয়েছেন। 


এছাড়াও 'শতপথ ব্রাহ্মণ' ও 'কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র'-এর মতো বৈদিক গ্রন্থে 'গঙ্গা'র উল্লেখ আছে। তবে, গঙ্গাকে নিয়ে গল্পগাথার উদ্ভব হয়েছে 'রামায়ণ', 'মহাভারত' ও পুরাণের যুগে।

'ব্রহ্ম পুরাণ'-এ গঙ্গার উদ্ভব সম্পর্কে একটি অভিনব গল্প আছে, যে-গল্পটির সঙ্গে অন্য কোন পুরাণের মিল নেই। সেখানে বলা হচ্ছে:

নারদের মুখে নামসংকীর্তন শুনে একবার হঠাৎ-ই বিষ্ণুর সমস্ত শরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তাঁর পা বেয়ে প্রবাহিত হতে লাগল আনন্দময় ঘামের স্রোত। দেখতে পেয়ে পরমপিতা ব্রহ্মা সেই স্রোত তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করলেন। স্রোতধারাটির নাম দিলেন, 'গঙ্গা'। 

'গঙ্গা' শব্দের মানে, 'যা গমন করে'। পৌরাণিক তত্ত্ববিশ্লেষক ঋষিরা এর মানে করেছেন, 'যে পবিত্র জলপ্রবাহে অবগাহন করলে ব্রহ্মপদের দিকে গমন করা যায়'। তাঁদের মতে, যেহেতু এই জল আসলে বিষ্ণুর পা ধোওয়া স্বেদজল, তাই তা সমস্ত পাপনাশ করে জীবকে মুক্তিদান করে। পুরাণকার ব্যাসদেব এই মোক্ষকল্পনাকে সার্থক করে তুলতেই সৃষ্টি করেছেন গঙ্গার মর্তলোকে আগমনের এক জমজমাট কাহিনি।


কাহিনিটি বেশ জটিল। 'মহাভারত'-এ বিস্তারিত আছে। সেটাই একটু সহজ করে এখানে বলার চেষ্টা করছি:


সগর নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি একবার বেশ আড়ম্বর করে অশ্বমেধ যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞ সফল হলেই তিনি স্বর্গের অধিপতি হবার ক্ষমতা পেয়ে যাবেন। ফলে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র যজ্ঞের সংবাদ পেয়ে বেজায় ভীত হলেন। তাই তিনি বিভ্রান্তি ঘটিয়ে যজ্ঞটাকে পণ্ড করার জন্য একটা মারাত্মক ষড়যন্ত্র করে ফেললেন।

যজ্ঞের ঘোড়া পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এলে তাকে বলি দিলে তবেই অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়। নইলে নয়। তাই  সগর তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে সেই ঘোড়াটার ওপর নজর রাখার দায়িত্ব দিলেন। তবুও ছলনার কলকাঠি নেড়ে ইন্দ্র তাঁদের নজর এড়িয়ে ঘোড়াটিকে চুরি করে কপিলমুনির আশ্রমে এনে বেঁধে দিলেন।

gangaDashohara2

ঘোড়া হারিয়ে সগরের তো বটেই, ষাট হাজার পুত্রও একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। তক্ষুনি শুরু করলেন অনুসন্ধান। 


অনুসন্ধান করতে করতে ষাট হাজার পুত্র হাজির হলেন সেই কপিলমুনির আশ্রমে। আশ্রমের আস্তাবলে সহজেই ঘোড়াটিকে দেখতে পেলেন তাঁরা। অমনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা কপিলমুনিকে চোর ঠাউরে বসলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা গেলেন চোরকে বেঁধে আনতে। আর তখনই বাধল বিপত্তি। 

কারণ, কপিলমুনি তো চুরি, চোর ধরতে আসা--এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। তিনি নির্বিবাদী মানুষ। ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু, এই অবস্থাতেই সগরের ষাট হাজার পুত্র তাঁকে ধ্যানের আসন থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে আনতে গেলেন! তাতেই অসময়ে মুনির ধ্যান ভেঙে গেল। আর ধ্যানভঙ্গ হতেই অসম্ভব রেগে তিনি চরম অভিশাপ দিয়ে তাঁদের তক্ষুনি ভস্ম করে দিলেন।

তখন সগর মহাশোকে মনস্তাপ আর মৃত ছেলেদের মুক্তির অনুনয় নিয়ে মুনির পায়ে এসে পড়লেন। তাতে মুনি খানিক শান্ত হয়ে নিদান দিলেন যে, বংশের কেউ যদি গঙ্গার জলে এই ষাট হাজার পুত্রের ভস্ম বা ছাই ভাসিয়ে দিতে পারে তবেই এঁদের মুক্তি হবে। অবশ্য তার জন্য আগে গঙ্গাকে মর্তে আনতে হবে।

বেশ। সগরবংশে পুরুষানুক্রমে চেষ্টা চলল গঙ্গাকে মর্তে আনার। কিন্তু, একে একে পূর্বপুরুষেরা ব্যর্থ হলেন, শেষে এল ভগীরথের পালা। 

ভগীরথ বহুবছরের তপস্যায় ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলেন। তাঁরই প্রার্থনায় ব্রহ্মা আপন কমণ্ডলুতে সঞ্চিত গঙ্গার ধারা বন্ধনমুক্ত করে ঝরতে দিলেন হিমালয়ের মাথায়, সেটা বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। 

তার এক মাস পর ভগীরথের প্রার্থনায় দশহরার দিন জ্যৈষ্ঠের শুক্লা দশমী তিথিতে হিমালয় থেকে গঙ্গার ধারা নেমে এল সমতলে। 

সমতলের ওপর দিয়ে বইতে বইতে পৌষ সংক্রান্তির দিন গঙ্গার সেই ধারা কপিলমুনির আশ্রমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সগরের ষাট হাজার পুত্রের ভস্ম ছুঁয়ে তাদের মুক্তি দিয়ে শেষে বঙ্গ উপসাগরে এসে মিশল। এই মিলনস্থানই হল মুক্তিতীর্থ 'সাগরসঙ্গম', যার অপর নাম 'গঙ্গাসাগর'।

কাহিনি থেকে পুণ্যকামীরা মনে করেন যে, পৌষ সংক্রান্তিতে সাগরসঙ্গমে স্নান ও ব্রতাদির মাধ্যমে যে পুণ্য, যে মোক্ষের সন্ধান মেলে; তারই অনুরূপ পুণ্য ও মোক্ষ মেলে দশহরার গঙ্গাস্নানে-ব্রতে-দানে-ধ্যানে। সে-জন্যই 'দশহরা' তাঁদের কাছে বড় প্রাপ্তির দিন, পুণ্যের দিন, আনন্দের দিন...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...