কথায় বলে শেষ পাতে দই মিষ্টি। সারা ভারতজুড়ে টক দইয়ের রমরমা থাকলেও বাংলায় এসে তার সব জাড়িজুড়ি শেষ হয়ে যায়। বাংলার ক্ষেত্রে একা কুম্ভোটি হলেন লাল মিষ্টি দই। ওপার বাংলার বাগুড়া জেলার দই অত্যন্ত বিখ্যাত। বগুড়ার দইয়ের ইতিহাস শুরু হয় বগুড়ার শেরপুর থেকে। স্থানীয়দের মতে, সনাতন ঘোষ সম্প্রদায় দই তৈরি করে বগুড়াকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। প্রথম দই তৈরি হয়েছিল আড়াইশো বছর আগে। তৎকালীন ঘোষ পরিবারের ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি করেন। প্রথম দিকে তিনিও টক দই বানাতেন। পরবর্তীকালে তিনিই চিনি পাতা মিষ্টি দই তৈরি করেন। এই বাংলার নবদ্বীপের দই অন্যতম প্রসিদ্ধ মিষ্টি পরিবারের কুলীন সদস্য।
নবদ্বীপের এই দই লাল দই, ক্ষীর দই এবং চাক্কু দই নামে পরিচিত। দুই বাংলায় দই তৈরির ক্ষেত্রে পদ্ধতি এবং উপকরনগত কোন পার্থক্যই পরিলক্ষিত হয় না। তবে কোনরকম রঙ ব্যবহার না করেই লালদই প্রস্তুত করা নবদ্বীপের কারিগরদের এক বিশেষ মুন্সিয়ানার ফল। লাল দইয়ের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। মনে করা হয় লাল দইয়ের আবিস্কর্তা হলেন কালীপদ মোদক মতান্তরে কালী ঘোষ। কালী ঘোষ এবং হরি ঘোষ; এই দুই ভাই নবদ্বীপের ফাঁসিতলার বাসিন্দা ছিলেন। তারা মূলতঃ দই এবং ঘোল তৈরী করতেন। অল্প আঁচে মোষের দুধ দীর্ঘক্ষন ফুটিয়ে ঘন করতেন। তার ফলে দুধের রঙ লালচে হয়ে যেত। এর থেকেই লাল দই নামের উদ্ভব। এই দুই ভাই সেই দুধের ঘোল এলাকায় বিক্রি করতেন, যা লাল ঘোল নামে পরিচিত ছিল। ঘন করে দুধ জাল দেওয়া হত বলে এই দই ক্ষীরদই নামেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এই দই এর আর একটি নাম হল চাক্কু দই। দই কতটা ভালো হয়েছে সেটার বিচার হয় দই কতটা আঁটো হয়েছে তার উপর। সেটি পরীক্ষা করার জন্য দই এর হাঁড়ি উল্টে দিয়েও দেখা হয়। এমন কি হাঁড়ির ভিতরে চাকু অথবা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েও দই-এর মান পরীক্ষার রীতির প্রচলন ছিল। এর থেকেই নাম হয় চাক্কুদই বা চাকু দই। পশ্চিমবাংলার দক্ষিন দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের ক্ষীর দই এর যথেষ্ট নামডাক। ঘন দই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলার এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে দই পাওয়া যায় না। দই মুলত চার প্রকার। যথা- ছাঁচি দই, কাঁচা দই, দগড়া দই এবং গলেয়া দই। তবে সাধারনভাবে দোকানে যে দই পাওয়া যায় তাকে ছাঁচি দই বলা যেতে পারে। হিন্দুদের কোন মাঙ্গলিক কাজ দই ছাড়া সম্পূর্ন হয় না। মিষ্টি দইয়ের প্রতি বাঙালিদের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। তবে হালে শেষ পাতের জন্য বাঙালি আইসক্রিমে মন মজিয়েছে, তবুও দইয়ের বনেদিয়ানা আজও অক্ষত। আজও সে শেষ পাতের ওস্তাদ।