দুর্গা প্রতিমার সৌন্দর্যের চালচিত্র

বাংলা সিনেমায় ঠাকুর দালান, নাটমন্দিরে প্রতিমা তৈরির দৃশ্য দেখতে আমরা বেশ অভ্যস্ত । ঠাকুর দালানে বসে শিল্পীর  মূর্তি রঙ করা, চালচিত্র আঁকা এগুলো খুবই পরিচিত সিকোয়েন্স এখন আমাদের কাছে। "জয়বাবা ফেলুনাথ" বা "উৎসব" বিভিন্ন সিনেমায় এই সিকোয়েন্স ঘুরে ফিরে এসেছে।  বাঙালি দর্শকের  কাছে যে বিষয়টি বেশ আবেদনপূর্ণ সেটিও বোঝা যায়। বাঙালি  দুর্গাপুজোর চারটে দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকে। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছবিতে শুধু প্রতিমা নয় চালচিত্র আঁকাতেও দেখা যায়।

দুর্গা প্রতিমাতেই সাধারণত চালচিত্র বেশি ব্যবহার হয়। অন্য দেব-দেবীর ক্ষেত্রে যে চালচিত্র দেখা যায় না তা নয়। তবে "চালচিত্র" মূলত দুর্গা প্রতিমার জন্যই জনপ্রিয়। প্রতিমার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাই মূলত চালচিত্রের কাজ। নামের মধ্যেই রয়েছে এর অর্থ। "চাল" শব্দের অর্থ "আচ্ছাদন"। অর্থাৎ আচ্ছাদনের উপর আঁকা হয় বলে এর নাম "চালচিত্র"।

প্রতিমার পশ্চাৎপট হিসেবেই চালচিত্র ব্যবহার করা হয়। চালচিত্র অঙ্কন মূর্তি গড়ার একটি প্রাচীন রীতি। একাসনে সমবেত প্রতিমার পাশাপাশি একক-প্রতিমার পিছনেও চালচিত্র থাকে, তবে তা তুলনায় কম। একক মূর্তির ক্ষেত্রে অনেক সময় চিত্রিত হয় না। চালচিত্র "পটলেখা", "দুর্গা চালা" বা "দেবী চালা" নামেও পরিচিত।

প্রতিমার চালির বিভিন্নতার উপর নির্ভর করে প্রতিমার  চালচিত্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। "বাংলা চালি", "খোপ চালি", "টানা চৌড়ি", "মঠ চৌড়ি" ও "মার্কিন চালি"। আবার বিষয়বস্তু অনুসারেও ভাগ রয়েছে। "কৈলাসী", "দশাবতারী", "বৃন্দাবনী", "রামচন্দ্রী" ইত্যাদি। বাংলার বনেদী বাড়ির প্রতিমা "কৈলাসী" ও "দশাবতারী" চালচিত্র বেশি হয়।

বাংলায় প্রতিমা নির্মাণ ধারায় দুটি রীতি রয়েছে। "বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা" ও "কংস নারায়ণ রীতির প্রতিমা"। কংস নারায়ণ রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য চালচিত্র। অর্ধবৃত্তাকার চালির ব্যবহার এই রীতিতে দেখা যায়। এর জন্য এই রীতি বেশ জনপ্রিয়।

শিব-দুর্গা, কৈলাস, শিব অনুচর নন্দী ভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার চালচিত্রের বিষয় হিসেবে দেখা যায়। বীরভূম জেলার "হাট সেরান্দির" সূত্রধর সমাজে এই সব বিষয় নিয়ে এক ধরণের চালচিত্র তৈরি হয়। তাকে "দুর্গাপট" বলা হয়ে থাকে। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির "রাজ রাজেশ্বরী" দুর্গার চালচিত্রের মাঝখানে থাকে পঞ্চানন শিব ও পার্বতী। একপাশে দশমহাবিদ্যা ও অন্যপাশে দশাবতার।

"মঠচৌরি" চালির চালচিত্রে দেবীর অবয়বগুলি উপর থেকে নিচে অর্থাৎ একটির নিচে অপরটি সাজানো থাকে। সাবেক "বাংলা চালি"তে সেগুলো থাক থাক করে আলাদা আলাদা ভাবে থাকে। "মার্কিন চালি"তে পটচিত্রগুলি থাকে পাশাপাশি।

মূর্তি আর চালচিত্র আলাদা ভাবে তৈরি হয়। চট, দরমা, কাপড় ইত্যাদি চালচিত্র প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি মেপে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তারপর গোলামাটির পলেস্তারা দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকিয়ে গেলে খড়িমাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর রঙ-তুলির সাহায্যে বিভিন্ন ছবি আঁকা হয়।

অধিকাংশ চালচিত্রের শীর্ষস্থানে থাকে শিব। মূলত শিব ও দুর্গা সম্পর্কিত নানা ঘটনার ধারাবাহিক চিত্রসহ অন্যান্য দেব-দেবী, তাঁদের বাহন, প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকা হয়। মাঝখানে থাকে পদ্ম অথবা সূর্যবলয়। পরিধি ধরে লতানো পদ্ম আঁকা হয়। এর উপরে এঁটে দেওয়া হয় নরম মাটির ছোট অলংকৃত সাঁচ। সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চালচিত্র দিয়ে প্রতিমার পিছনদিকটি আচ্ছাদিত করেন প্রতিমাশিল্পী।

চালচিত্রে শিল্পীরা প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করেন। নীল, হলুদ, সবুজ, লাল, খয়েরি, কালো ও সাদা রঙ বেশি ব্যবহৃত হয়। চালচিত্রের অঙ্কন রীতিই পটুয়ারা তাদের পটচিত্রে অনুকরণ করেন। সাদা রঙের জন্য খড়িমাটি, হলুদ রঙের জন্য পিউরি, নীল রঙের জন্য খেতের নীল, কালো রঙের জন্য  ভুষোকালি ও লাল রঙের জন্য মেটে সিন্দুর ব্যবহার করা হয়।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির "রাজা-রাজেশ্বরী" দুর্গা চালচিত্রের জন্য প্রসিদ্ধ। কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বৈষ্ণব দাস মল্লিক ও হাওয়ার রামকৃষ্ণ পুরের বসু পরিবারের পট লেখার ঐতিহ্য এখনও টিকে আছে।

দুর্গা প্রতিমায় চালচিত্র বেশি দেখা গেলেও কালী, সরস্বতী ও অন্যান্য প্রতিমার পিছনেও চালচিত্র দেখা যায়। তবে তা সব সময় চিত্রিত হয় না। এইসব চালচিত্রে শিল্পী একক রঙের পোঁচ দেন। অবশ্যই প্রতিমার মোটিফ অনুযায়ী। কালীর মূর্তিতে লাল রঙ ও সরস্বতীর ক্ষেত্রে সাদা রঙ ব্যবহার হয়।

চালচিত্র আগে পটুয়া সম্প্রদায়রাই তৈরি করতেন। পরবর্তীকালে পটুয়া-শিল্পের ঘাটতি দেখা দিলে প্রতিমাশিল্পীরা নিজেরাই চালচিত্র তৈরি করে নিতেন। বর্তমানে "ডাকের- সাজ" প্রচলন হওয়ায় চালচিত্রের ব্যবহার কমে এসেছে। এখন রঙিন কাগজ, শোলা বা রাংতার সাজ বেশি দেখা যায়।

থিম পুজোর দাপটে পুজোর সাবেকি আনা অনেকটাই ম্লান। বনেদি বাড়িগুলো সেটা কিছুটা ধরে রেখেছে। ফলে বারোয়াড়ি পুজোয় চালচিত্রের প্রচলন কমে এলেও বনেদি বাড়ির বা ঘরোয়া প্রতিমায় চালচিত্রের অস্তিত্ব বহমান।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...