জাতীয় গণিত দিবস

অঙ্ক কী কঠিন! চন্দ্রবিন্দুর এই গানের চরণকে ভুল প্রমান করা লোকটির জন্মদিন আজ। অঙ্ক আমাদের অনেকের কাছেই ত্রাসের নাম, আবার কারোও কাছে সে জলভাত, সহজ-সরল মজার জিনিস। সেই অঙ্কের জন্যই একটি দিন। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের একটি অঙ্কের দিন আছে। আজ ২২শে ডিসেম্বর হল গণিতের জন্য বরাদ্দ একটি দিন, গণিত দিবস। কিন্তু এই দিবস এল কোথা থেকে? দ্যি ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি দেখেছেন? সেই অসম্ভব প্রতিভাধর, অতিমানবীয় মেধার জন্মদিন আজ।

প্রতি বছর ২২ ডিসেম্বর, গণিত দিবসটি দিনটি বিশ্ববন্দিত ভারতের কৃতি সন্তান, গণিতবিদ রামানুজনের জন্মদিনে পালিত হয়। গণিতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনন্য।

২০১২ সালের ২২শে ডিসেম্বর, ভারতের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রামানুজন-এর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীতে এই দিনটিকে জাতীয় গণিত দিবস হিসাবে পালন করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর থেকেই ২২ ডিসেম্বর সারা দেশে গণিত দিবস হিসাবে পালিত হয়। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনের মূল উদ্দেশ্য গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে, অঙ্কের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব আনতে, তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে, উৎসাহিত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক বিস্ময় প্রতিভার নাম রামানুজন, সংখ্যা, গণিত তাঁর কাছে যেন জলভাত। তিনি সংখ্যা নিয়ে যেন খেলা করতেন। এমনকি মৃত্যুশয্যায় শুয়েও তিনি এগিয়ে দিয়েছেন গণিতকে, আবিষ্কার করে গিয়েছেন এক নতুন দিগন্ত। কটা মানুষ এমন পারে?

১৮৮৭-র ২২শে ডিসেম্বর মাদ্রাজে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। মা ভজনগায়িকা কোমলাতাম্মাল এবং বাবা কাপড়ের দোকানে মুহুরি শ্রীনিবাস। তামিল প্রথা ছেলের নামেও তাই শ্রীনিবাস হাজির। শিশুর জন্মরাশির মিল বৈষ্ণব গুরু রামানুজের ঠিকুজির সঙ্গে, জনশ্রুতি রয়েছে দেবী নামগিরির আরাধনায় তাঁর জন্ম। সন্তানের জন্মের এক বছরের মাথায় কোমলাতাম্মাল বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন স্বামীর বাড়িতে কুম্বাকোনামে। আর সেখানেই একটু একটু করে বড় হতে থাকেন রামানুজন। বাবা সারাদিন দোকানে। তাই কেবল মায়ের আদর, শাসন আর তালিমেই দিন কাটে শিশু রামানুজনের। অনেক দিন, প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত। তার পর কোমলাম্মাল ছেলেকে ভর্তি করে দেন টাউন হাই স্কুলে। ১০ বছর বয়সে গণিতের সঙ্গে রামানুজনের পরিচয় ঘটে, এস এল লোনির ত্রিকোণমিতির একটি বই দেওয়া হয় তাঁকে। সেই শুরু তখন থেকেই গণিতে ঝোঁক বাড়তে থাকে রামানুজনের। বাকিটা ইতিহাস। অল্প দিনের মধ্যেই ত্রিকোণমিতিকে এক্কেবারে আয়ত্ত করে ফেলেন।

অন্য কোনও বিষয় নয়, কেবল অঙ্কের ক্লাসে রামানুজনের অন্য মূর্তি। কঠিন অঙ্ক সহপাঠীরা কষিয়ে নেয় তাঁকে দিয়ে। তাঁর এক-একটা প্রশ্নে ঘাবড়ে যান মাস্টারমশাইরা। এমনকী নিজেও কিছু উপপাদ্য আবিষ্কার করেন এবং বিখ্যাত অয়েলারের এককত্ব পুন:আবিষ্কার করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে রামানুজন বার্নোলির সংখ্যা ও অয়েলার-মাসেরনি ধ্রুবকের ওপর নিজের গবেষণা সম্পন্ন করেন। কুম্বাকোটম সরকারি কলেজে পড়ার জন্য বৃত্তি পেলেও অ-গণিতীয় বিষয়ে ফেল করার কারণে তাঁর বৃত্তি বাতিল হযে যায়। এর পর তিনি অন্য একটি কলেজে নিজের গাণিতিক গবেষণা শুরু করেন।

কিন্তু বাড়ির অবস্থা ভাল না। আয় করতে হবে, চাকরি চাই। কোথায় পাবেন চাকরি, তার তো কোনও ডিগ্রি নেই। আছে কেবল কিছু নোটবই। তাতে ঠাসা অঙ্কের ফর্মুলা, যেগুলি তিনি লিখেছেন রাতের পর রাত জেগে। হন্যে হয়ে ঘুরছেন রামানুজন।
চাকরির খোঁজে দ্বারে দ্বারে ওই নোটবইগুলোই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন তিনি। যাতে ডিগ্রি না থাকাটা ঢাকা পড়ে যায়। রামানুজন যেন এক সেলসম্যান, নিজেই নিজেকে বিক্রি করতে নেমেছেন।

এর মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন, কোমলাতাম্মাল। পাত্রীর বয়স দশ, নাম জানকী। সংসার বেড়েছে,বাবার একার সামান্য আয়ে হয় না। একটা চাকরি পেতেই হবে। অবশেষে মেলে চাকরি। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে পঁচিশ টাকা মাইনের চাকরি। রামানুজন খুশ। চাকরি পেয়ে অন্নচিন্তা দূর হয়েছে। রামানুজন এখন ফের গণিতসাগরের ডুবুরি। অফিসে পড়ে থাকে মালপত্র প্যাকিংয়ের ফেলে দেওয়া মোড়কের কাগজ, রামানুজন কুড়িয়ে নেন সেগুলো। অঙ্ক কষেন!

মনের ভুলে একদিন অফিসের খাতার উপরেই অঙ্ক কষে ফেলেন। দেখতে পেয়ে বেজায় খেপলেন উপরওয়ালা!
পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করার সময় কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় যাঁরা তাঁর নোটবুক নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেন। এর সূত্র ধরেই গণিত বিষয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়।

যেমন রামচন্দ্র রাও মাদ্রাজ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের মি. গ্রিফিথ-কে রামানুজনের ব্যাপারে বলেন। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর সঙ্গে মি. গ্রিফিথ এর আলাপ হওয়ার পর থেকেই রামানুজনের প্রতিভার স্বীকৃতি শুরু হয়। ১৯১১ সালে তাঁর প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ ‘জার্নাল অফ দ্য ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সংখ্যাতত্ত্বের উপর তাঁর গবেষণালদ্ধ ‘সাম প্রপার্টিজ অফ বারনৌলিস নাম্বারস’ নামে তাঁর প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ একই বছর প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে একই পত্রিকায় তাঁর আরও দু’টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং সমাধানের জন্য কিছু প্রশ্নও প্রকাশিত হয়।

তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। গুণগ্রাহীর সংখ্যা এ দেশে তেমন হবে না বুঝতে পেরে, রামানুজন তাঁর প্রবন্ধ পাঠালেন বিলেতে। প্রথমে লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হেনরি ফ্রেডরিখ বেকারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাঁর জবাব মেলেনি, এর পর রয়াল সোসাইটির সদস্য আর্নেস্ট উইলিয়াম হবসনকে। এ বারেও কিছু হল না। তার পর আরেক গণিতজ্ঞকে চিঠি লিখলেন। মাদ্রাজে বসেই ১৯১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি রামানুজন চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠির প্রাপক ছিলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ফেলো জি এইচ হার্ডি। চিঠির সঙ্গেই ফর্মুলার একই পাহাড় পাঠিয়েছিলেন রামানুজন। ১২০টি উপপাদ্য সংযোজিত ছিল, তার ভিতর থেকে নমুনাস্বরূপ হার্ডি ১৫টি নির্বাচন করেন। তিনি এমন কিছু বিষয় ও সমস্যার উপস্থাপনা করেছেন যা ইউরোপের অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানীরা ১০০ বছর ধরে সমাধান করেছেন, এমনকী কিছু এখনও সমাধান হয়নি।

বেকার এবং হবসন যা খুঁজে পাননি, তাই পেলেন হার্ডি। আসলে, রতনে রতন চেনে। প্রথমটায় হার্ডিও খানিকটা ধন্দে ছিলেন ফর্মুলাগুলো পাগলের প্রলাপ নয় তো? পরে বুঝলেন বানিয়ে বানিয়ে এমন সুন্দর ফর্মুলা কেউ তৈরি করতে পারে না। এগুলো আবিষ্কারের ফসল।

মুগ্ধ হার্ডি কেমব্রিজে গিয়ে গবেষণা করার প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবে রামানুজন আহ্লাদে আটখানা।
ছেলে এক পায়ে খাড়া কিন্তু বাধ সাধলেন মা কোমলাতাম্মাল।

গোঁড়া তামিল ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে কালাপানি পেরোলে তাঁদের জাত যাবে। অবশেষে মত দেন তিনি। কারণটা শোনা যায়, স্বপ্ন; কোমলাতাম্মাল স্বপ্নে রামানুজনকে সাহেব পোশাকে দেখেন। আর সেখানে আবির্ভূতা হন দেবী নামগিরি। তিনি আদেশ দেন কোমলাতাম্মালকে। রামানুজনের জীবনের লক্ষ্যপূরণে তিনি যেন আর বাধা হয়ে না দাঁড়ান। স্বপ্নাদেশ হয় রামানুজনেরও। নামাক্কালে দেবী নামগিরির মন্দিরে। ওখানে এক রাত্রে ঘুমের ভিতর রামানুজন দেখেন এক জ্যোতি। আর শোনেন বিদেশযাত্রার নির্দেশ। রামানুজন রীতিমতো ঈশ্বরবিশ্বাসী।

নিজে প্রায়ই বলতেন, 'আমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে নতুন নতুন ফর্মুলা আবিষ্কারের দিকে।... একটা সমীকরণের কোনও দামই নেই আমার কাছে, যদি না তাতে প্রতিভাত হয় ঈশ্বরের মনের কথা।' এমনকি ভাগ্যেও বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। নিজেই নিজের হাত দেখে বলেছিলেন, '৩৫ বছরের বেশি আয়ু নেই আমার।'

কেমব্রিজে অনেকে বারবার জানতে চেয়েছেন, রামানুজন তাঁর ফর্মুলাগুলো কোথা থেকে পান ? ওঁর একই জবাব, 'দেবী নামগিরি আমাকে ওগুলো স্বপ্নে দেন।'

১৯১৩-এর ১৭ মার্চ রওনা দিলেন রামানুজন, জাহাজ পৌঁছল ১৪ এপ্রিল। কেমব্রিজ-এর আমন্ত্রণে বিদেশে আসার অল্প দিন পরই রামানুজন ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ পেয়ে যান। হার্ডি, জন এডেনসর লিটলউডের মতো গণিতজ্ঞদের সান্নিধ্য। এ রকম পরিবেশই তো চিরকাল চেয়ে এসেছেন রামানুজন। এগোতে থাকে গবেষণা। কখনও একা, কখনও যৌথ ভাবে হার্ডির সঙ্গে। সে সব গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় লন্ডন ম্যাথমেটিকাল সোসাইটির জার্নালে। যৌগিক সংখ্যার উপরে থিসিস লিখে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামানুজন তাঁর জীবনের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেন।

রামানুজনের মতো হার্ডিও কিন্তু নাম্বার থিয়োরিস্ট। সংখ্যা নিয়েই কারবার তাদের দুজনের। হার্ডি যা ভাবেননি, তাই রামানুজন ভেবেছিলেন। একটা ঘটনা লোকের মুখে মুখে ফেরে, অসুস্থ রামানুজন পুটনি শহরে এক স্যানিটোরিয়ামে চিকিৎসাধীন। তাঁকে দেখতে এসেছেন হার্ডি। আসার সময়ে যে ট্যাক্সিটায় চড়েছেন তিনি, তার নম্বর ১৭২৯।

তাঁর মনে হয়েছে, সংখ্যাটা বাজে। সে কথা বললেন রামানুজনকে। রামানুজন বললেন, 'না, না হার্ডি, ১৭২৯ একটা বাজে সংখ্যা নয়। ওটা একটা মজার সংখ্যা। ওর চেয়ে ছোট কোনও সংখ্যা দুই জোড়া ঘন সংখ্যার সমষ্টি নয়।' রোগশয্যায় একটা সংখ্যার কথা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়াই বুঝিয়ে দেয়, তিনি সংখ্যা নিয়ে কতটা ভাবতেন। সংখ্যার উপরে ভিন্ন এক আকর্ষণ ছিল তাঁর। এক দিকে আবিষ্কারের অশ্বমেধের ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, অন্যদিকে তিনি ক্ষয়ে যাচ্ছেন।

বিদেশের আত্মীয়-পরিজনহীন জীবন, মা এবং স্ত্রীর কলহ রামানুজনের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। তাঁর মানসিক শান্তি, শারীরিক সুখ চলে যায়। এক সময়ে বাড়ির চিঠি না পেয়ে গুম হয়ে বসে থাকেন তিনি। লন্ডনের শীতে কাবু হয়েছিলেন, তার উপর মায়ের কথা রাখতে নিরামিষ আহার, হাত পুড়িয়ে রান্না, এক বেলা খেতেন কাজ বাঁচাতে। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল। হঠাৎ খবর পেলেন, তাঁকেই চিঠি পাঠানোর অপরাধে, স্ত্রী জানকীকে বাড়ি থেকে প্রায় এক রকম তাড়িয়েই দিয়েছেন মা কোমলাতাম্মাল। শাশুড়িকে না জানিয়ে স্বামীকে চিঠি লিখেছিলেন একটা!ঐ চিঠিটা কোমলাতাম্মালের হাতে পড়ে যায়। তাতেই যত গন্ডগোল। শোনা যায়, কোনও একটা সময়ে লন্ডনে মেট্রো রেলের লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যান রামানুজন, যদিও ধরা পড়ে যান পুলিশের হাতে। মুচলেকা দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান হার্ডি। যক্ষ্মা আর তীব্র আমাশায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

১৯১৯ সালের ২৭ মার্চ ভগ্ন শরীরে দেশে ফিরে আসেন রামানুজন। মৃত্যুশয্যায় অঙ্কই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়। কাশি থামলেই হাত বাড়িয়ে জানকীর কাছে স্লেট বা কাগজ চাইতেন। মারা যাওয়ার চার দিন আগে পর্যন্ত কাজ করেছেন নতুন ফর্মুলা নিয়ে, ১৯২০ সালের ২৬শে এপ্রিল চলে গেলেন ম্যাথামেটিক্সের ম্যাজিশিয়ান।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...