পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, সত্য যুগে দক্ষযজ্ঞে সতী শিব নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। এরপর মহাদেব দক্ষকে বধ করতে কালভৈরবকে পাঠান। সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে মহাদেবে তান্ডবলীলায় মত্ত হয়েছিলেন। নটরাজের তান্ডব নৃত্য থামানোর জন্য শ্রী বিষ্ণুর নিক্ষেপ করা সুদর্শন চক্রে খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায় সতীর দেহ এবং সতীর দেহ খন্ডগুলি যেখানে পড়ে সেখানেই তৈরি হয় এক একটি সতীপীঠ। এই মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জ অথবা সাতকুড়া অঞ্চলে অবস্থিত। যদিও, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ এখনও অজানা। কারন, এটি এমন একটি সতীপীঠ যা বহু শতাব্দী পূর্বে তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। মন্দির চত্বরে জোরা বট গাছ খুব আকর্ষণীয়। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সতীপীঠ খুবই জাগ্রত।
সতীরপীঠের মধ্যে অন্যতম হল সতীপীঠ ভ্রামরী। জলপাইগুড়ির তিস্তা নদীর তীরে শালবাড়ি গ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ। এই মন্দিরটি নদীর তিন স্রোতের মধ্যে অবস্থিত বলে একে ত্রিস্রোতা মন্দিরও বলা হয়। বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত মন্দিরকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। জনশ্রুতি অনুসারে, দেবী সতীর বাম চরণ পড়েছিল ত্রিস্রোতায়। দেবী এখানে ভ্রামরী নামে পূজিত হন। ভৈরবের নাম ঈশ্বর। দেবী ভ্রামরীও অন্যতম আদি শক্তি।
জলপাইগুড়ি জেলার অন্যতম বিখ্যাত মন্দির হল এই ভ্রামরীদেবীর মন্দির। গা ছমছমে পরিবেশ, জোড়া গাছ, সতীর বাম পা ইত্যাদি মিলিয়ে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার আকর হল এই মন্দির। জলপাইগুড়ি শহরের গোশালা মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলেই চোখে পড়বে ডোমাকৃতির মন্দির। গোশালা মোড় দিয়ে দেবী চৌধুরানী মন্দিরের বামদিকের রাস্তা ধরে এগোলেই একটু দূরে চোখে পড়বে ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান ও বোদাগঞ্জ। তিস্তানদীর পাশ ধরে এই মায়াবী মন্দির, বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের সারিবদ্ধ শাল ও সেগুন গাছ। চারিদিকে একটা মায়াবী এবং অলৌকিক পরিবেশের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্রামরীর মন্দির। স্থানীয়দের একাংশের বিশ্বাস, বিশেষ বিশেষ দিনে ভ্রামরী দেবীর মন্দির থেকে গভীর রাতে নূপুরের আওয়াজ ভেসে আসে আজও!
শোনা যায়, একদা অরুণাসুর নামে এক ভয়ংকর অসুরের বাস করত পৃথিবীতে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন স্বর্গের দেবতারা।পুরাণে রয়েছে অরুণাসুরের আক্রমণে পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত, তখন দেবী পার্বতী এই রূপ নেন। অরুণাসুরের বোন বজ্রজ্বালার ইচ্ছে হল যে, সে চন্দ্রদেবের রাণী হিসেবে চিরকাল থেকে যাবেন। কিন্তু চন্দ্র তার বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাহার করলে বোনের অপমানের শোধ নিতে অরুণাসুর ব্রহ্মার থেকে বর চায় যে কোন দ্বিপদী বা চতুষ্পদী প্রাণী তাকে হত্যা করতে পারবে না। সে ক্রোধে দেবতাদের বন্দী করল।এরপর, সেই অসুরের অত্যাচারে তীব্র আতঙ্কিত হয়ে দেবীর শরণাপন্ন হন দেবতারা। বরে উন্মত্ত হয়ে সে কৈলাসে যখন দেবী পার্বতীকে আক্রমণ করল, তখন দেবী ভ্রামরী রূপ ধরে যুদ্ধে অগ্রগমণ করেন। ভ্রামরী শতসহস্র ভ্রমরকে পাঠালে যুদ্ধাঙ্গনে তারা অরুণাসুরকে দংশন করে ও তাকে সম্পূর্ণ ভক্ষণ করে ও তার মৃত্যু হয়।
আবার শোনা যায়, দেবী সকলকে রক্ষা করার জন্য অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধারণ করে ওই অসুরকে পরাজিত করেন। সেই থেকে দেবী ভ্রামরী নামে পরিচিতা হন। এছাড়াও অনেকের মতে, হৃদয়স্থিত দ্বাদশদল পদ্মে অবস্থিতা দেবী।
মূল দেবীমন্দিরে প্রবেশের মুখে রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই রয়েছে দেবীমূর্তি। দেবী সালঙ্কারা ও অষ্টভূজা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় কলসের উপর রয়েছে পুষ্পপত্র। পাশে রাখা থাকে পিতলের তৈরি দেবীর চরণদ্বয়। যা পূজিত হয়। দেবীর ডান পাশে রয়েছে মহাদেবের মূর্তি। সেই কক্ষের থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্রামরী মাতার মন্দিরের গর্ভগৃহে। যেখানে দেবী সিংহবাহনা। দেবীর গাত্র কৃষ্ণবর্না। সামনের বেদীতেই থাকে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ।
শরৎকালে নবরাত্রির পুজোয় সেজে ওঠে এই মন্দির। দেবীর আরাধনা চলে। ভক্ত সমাগম হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানে বিভিন্ন পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজো উপলক্ষ্যে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। এছাড়াও, এই মন্দিরে দুর্গাপুজো ও মাঘী পূর্নিমায় বিশেষ পুজো ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরটি তৈরির সঠিক তারিখ এখনও অজানা । কারণ এটি এমন এক শক্তিপীঠ যা বহু শতাব্দী পূর্বে তৈরি হয়েছিল। মন্দির চত্বরে জোরা বট গাছ খুব আকর্ষণীয়। মূলমন্দিরে দেবীমূর্তি রয়েছে। দেবী অলঙ্কারে ভূষিত ও অষ্টভূজা। দেবীর সামনে বড় বড় কলস আছে। কলসের উপরে পুষ্পপত্র আছে। মন্দিরের ভেতরে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা। এই মন্দির থেকে একটু বেরিয়ে প্রাঙ্গণের ভেতরে ডানেই রয়েছে জোড়াবট। গাছের নীচে রয়েছে লোকনাথ বাবার মূর্তি। জোড়াবট বিরাজমান। বিশালাকৃতির দুটো গাছ আলাদা আলাদা থাকলেও উপরে উঠে একসঙ্গে মিলে যায়। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে শাখা প্রশাখা।
মন্দির নিয়ে অজস্র জনশ্রুতি রয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এক লাল কাপড় পরা মহারাজ এসেছিলেন মন্দিরে। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশাল জটা ছিল। তিনি দীর্ঘদিন মন্দিরে পূজা ও যজ্ঞ করেন। তিনিই তিনটি মোটা গাছের গুড়ির নিচে মায়ের পাথররুপী বাম পার সন্ধান পান। এরপর সাধুসন্ত রামন্দিরে আসতে শুরু করে।
মন্দিরের প্রবেশপথের উপরে রয়েছে শিব-পার্বতীর বসে থাকার মূর্তি। মূল মন্দিরের প্রবেশমুখের বাঁদিকে রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশ। গণেশের আরাধনা করেই মন্দিরে প্রবেশ করেন অনেকে। দেবীমূর্তি দেখে মন ছুঁয়ে যাবে। দেবী অষ্টভূজা, সালংকারা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় পাত্রে রাখা রয়েছে ভক্তদের নিবেদন। মন্দির প্রাঙ্গণেই রয়েছে বিশাল এক দালান। সেখানকার দেওয়ালে দেওয়ালে রয়েছে দেবদেবীর চিত্র। সিংহবাহিনী কৃষ্ণবর্ণা দেবীর মূর্তি। পাশে রয়েছে সতীর বাম পা। সেই পা রীতিমত রক্তবর্ণ লাল। মহিলাদের নিবেদনের সিঁদুর ও ফুল দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে সেই গর্ভগৃহ। মহাদেবের মূর্তি রয়েছে দেবীর ডানপাশে এবং তাঁর পাশেই রয়েছে ষাড়রূপী নন্দী।
মূলত স্থানীয়দের উদ্যোগেই এখানে পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে পূজার চাঁদার জন্য আলাদা করে কারও বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না সকলেই মন্দিরে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পুজো উপলক্ষে চণ্ডীপাঠ এবং খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। এখানে এখনও প্রচলিত আছে বলি প্রথা। তবে কবে এই পূজা শুরু হয়েছে তা জানা যায় না। প্রতি বছর এখানে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে কালীপুজো করা হয়, গভীর রাত অবধি পুজো চলে। সারা বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখানে পুজো দিতে আসেন। ভোগের প্রসাদ নিতে ও মায়ের আশীর্বাদ নিতে আসেন বহু মানুষ। অমাবস্যার সময়েও নিয়মিত পুজো হয়।