দীপ হাতে এক বালিকা। তার হাতে ধরা সারি সারি প্রদীপ। এক সঙ্গে জ্বলে উঠলে আলোয় ভরে যায় গোটা ঘর। এই বালিকা যেমন-তেমন বালিকা নয়, সে আসলে মাটি-কন্যা। মাটির তৈরি ‘পুত্তলি’। চলতে ভাষায় যাকে বলা হয় দেওয়ালি পুতুল।
দীপাবলি কাছে আসলেই মাটির প্রদীপের চাহিদা বাড়ি। ফুটপাত জুড়ে স্টল বসে মাটির প্রদীপ আর আলোক সামগ্রীর। সেখানেই দেখা মেলে ‘দেওয়ালি ’ পুতুলের।
সংস্কৃত শব্দ দীপাবলী থেকে ‘দেয়ালী’ কথাটি এসেছে। হিন্দি শব্দ ‘দিয়া’ থেকে দেওয়ালি ।
কার্তিক অমাবস্যায় কালীপুজোর রাতে প্রদীপ, মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয় ঘর। তারই অঙ্গ দেওয়ালি পুতুল। আসলে বাতিদান।
দেওয়ালি পুতুল তৈরি হয় মূলত পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলাতে।
দেওয়ালি পুতুলের গঠন অন্যান্য মাটির পুতুলের থেকে আলাদা। স্ত্রী পুতুলের এক শরীর। হাত দেহের তুলনায় লম্বা। চেহারায় অবাঙালি প্রভাব স্পষ্ট। পুতুলের পরনে ঘাঘরা-চোলি। মাটি দিয়ে তার আকার দেওয়া হয়েছে।
গবেষকরা বলেন সিন্ধু প্রদেশ এবং মহেঞ্জদাড়ো খননের সময় যে ধরনের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল তার গঠনের সঙ্গে দেওয়ালি পুতুলের চেহারার অদ্ভুত মিল আছে। আগে পুতুলের হাতে সাতটি প্রদীপ থাকত। সেই কারণে এই পুতুল সাতবহানিয়া নামেও পরিচিত ছিল। এখন চাহিদা অনুযায়ী হাতের সংখ্যা বাড়ে-কমে। উচ্চতাও ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বাড়ে। তিনফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এই পুতুল। তবে ছোট পুতুলেরই চাহিদা বেশি।
রাঢ় বঙ্গে তৈরি পুতুলের পরনে ঘাঘরা-চোলি কেন সে উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষকদের মত পুতুল তৈরির পটুয়াদের অনেকের পূর্বপুরুষই ঝাড়খন্ড, ছোটনাগপুর, বিহার থেকে এসেছিলেন। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল হাতে গড়া পুতুলেও। তাই বাংলার পুতুল শাড়ির বদলে সেজে উঠেছিল ঘাঘরায়।
মেদিনীপুরে দেওয়ালি পুতুল তৈরি হয় কাঁসাই নদীর মাটি দিয়ে। নদীর চর থেকে তুলে আনা হয় কালো মাটি। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া হয় বালি। হাত দিয়ে মাখার পর ছাঁচে তৈরি হয় পুতুলের মুখ। শুকনো হওয়ার পর দেওয়া হয় ভাটিতে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। কারণ ভাটিতে ধোঁইয়া জমলেই বদলে যাবে পুতুলের রং। খেয়াল রাখতে হয় সেদিকে। টানা ১০ ঘন্টা জ্বাল চলে।
পুতুল ‘পেকে’ গেলে শুরু হয় রং পর্ব। লাল, নীল, সবুজ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে পুতুল। তবে আসমানী রঙের পুতুল শুধুমাত্র মেদিনীপুরেই পাওয়া যায়।
দেওয়ালি পুতুলকে অনেক জায়গায় আবার পরী পুতুল, দীপাঙ্গনাও বলা হয়ে থাকে।
তথ্য সূত্রঃ সপ্তডিঙা