কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের সেন্ট জনস গির্জা। এই অঞ্চল ইংরেজ সমাধিক্ষেত্র। এখানেই শায়িত জব চার্নক। নির্জন ভূমি আলো করে দাঁড়িয়ে সাদা ফুলের গাছ। তারই মধ্যে একটি সমাধি ফলকে লেখা, ‘ oldest british resident in Bengal, universally beloved, respected and reverted.’
ফলকে লেখা নামটি ফ্রান্সিস জনসন। আসল নাম ফ্রান্সিস ক্রুক। জন্ম ১৭২৫, ১০ এপ্রিল। চেন্নাইয়ের দক্ষিণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য ঘাঁটি সেন্ট ডেভিডে। বাবা এডওয়ার্ড ক্রুক। ফোর্ট ডেভিডের গভর্নর। মা পর্তুগিজ।
ছোট থেকেই ফ্রান্সিস হাসিখুশি নজর কেড়ে নেওয়া মিষ্টি স্বভাবের এক মানুষ। বৈভবে মানুষ। সকলের সঙ্গে সহজ ভাবে মেশার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল। ভারতে তখন মুঘল শাসন। মাত্র ১৩বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল ফ্রান্সিসের। কলকাতার তৎকালীন গভর্নরের ভাইপো প্যারি টেম্পলারের সঙ্গে। দুই সন্তানও হয়। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামী ও সন্তানদের হারান।
ততদিনে কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। এখানেই জেমস এলথাম নামে কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মীর সঙ্গে ফের বিবাহ করলেন। কিন্তু ফ্রান্সিসের জীবনে অন্ধকার পিছু ছাড়ে না যেন, বিয়ের মাত্র ১২ দিনের মাথায় বসন্তে মৃত্যু হল স্বামীর।
ফ্রান্সিস অন্ধকারকে কখনও মানতে পারেননি নিজের জীবনে। ভাগ্যের হাতে সঁপে দেওয়ার ভাবনায় একেবারেই বিশ্বাসী ছিলেন না। ভালো কথা বলতে পারতেন। গল্প বলার দক্ষতা মুগ্ধ করত যে কোনও মানুষকে। সেই জন্য সব মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। জীবনের একাকীত্বকে মানবেন কেন তিনি!
চব্বিশ বছর বয়সে বিয়ে হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য উইলিয়াম ওয়াটসনকে।
ফ্রান্সিসের জীবন রোমাঞ্চে ভরপুর। সেই নাটকীয়তা রঙ্গমঞ্চকেও হার মানায়।
বিয়ের পর দুই সন্তান হল তাঁর। সেই সময়ই কলকাতায় সস্ত্রীক ওয়াটসন বন্দি হলেন সিরাজদ্দৌলার হাতে। ওয়াটসনের জায়গা হল কারাগারে। কিন্তু স্ত্রী সন্তানদের কী হবে? তারাও তো বন্দী। সিরাজ নিজের দিদার কাছে তাদের রেখে মুর্শিদাবাদ চললেন।
ফ্রান্সিস বাংলা বলতে শিখেছিলেন। নিজের স্বভাব আর মিষ্টি কথায় সিরাজের দিদার মন জয় করে মুক্ত হয়েছিলেন। সেই থেকে তার নামের সঙ্গে বেগম কথাটি জুড়ে যায়।
ওয়াটসন ছাড়া পাওয়ার পর রাজ পুরুষ হিসাবে ভারতে বেশ কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারপর সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে যান। কিন্তু বারবার ফ্রান্সিস কলকাতা ফিরতে চসিতেন। মনে প্রাণে দেশ ভাবতেন ভারতকে। কলকাতা তাঁর যৌবনের টান। কলকাতার মানুষদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। এই শহরে ফেরার সুযোগ তাঁর কাছে এসেছিল।
১৭৬৪ তে ওয়াটসন মারা যান। তার পাঁচবছর পর বেগম জনসন ফিরে আসেন কলকাতায়। এবার একা। জাহাজ যাত্রায়।
বিয়ের সূত্রেই ক্ষমতা আর বৈভবের অধিকারিণী হয়েছিলেন। কিন্তু বেগমের জনপ্রিয়তা তাঁর রঙিন স্বভাবের জন্য। কলকাতার এলিটমহলে বেগম জনসন একটি নন। ফেয়ারলী প্যালেসে বসত আড্ডার আসর। ব্রিটিশ অভিজাত মহিলারা তো বটেই পুরুষরাও আসতেন তাঁর গল্প শুনতে।
একা থাকা ফ্রান্সিস কখনও মানতে পারেননি। কলকাতায় ফিরে সেনাবাহিনীর যাজক উইলিয়াম জনসনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন। উইলিয়াম কলকাতার সেন্ট জনস চার্চ নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্ত্রীকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য বহুবার সাধ্য সাধনা করেন। কিন্তু সাগর পেরবার ভাবনাকে কখনও মেনে নিতে পারেননি বেগম। তিনি চেয়েছিলেন বাকি জীবন এই শহরে, এই সংস্কৃতিতেই মিশে যাক তাঁর। সেভাবেই চলেছিল জীবন।
১৮১২ সালে প্রয়াত হন ফ্রান্সিস জনসন। কলকাতার প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব, কাউন্সিল সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের জজ উপস্থিত ছিলেন শেষ যাত্রায়। এমনকি হাজির ছিলেন বড়লাট মিন্টোও।
সেন্ট জনস চার্চ তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সমাধি ক্ষেত্র হিসেবে। কিন্তু তিনি আগামঅনুমতি আদায় করে রেখে ছিলেন বড়লাট ওয়েলেসলির কাছ থেকে। মৃত্যুর পর পরিবার দূরে থাকলেও এই শহরই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিবার।
কাকতলীয় ভাবে ওই বছরই মানে ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন রবার্ট জেনকিন্স। কলকাতার ফ্রান্সিস ছিলেন তাঁর আপন দিদিমা।