পুরো নাম অশোক ভীমচন্দ্র দিন্দা, বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী পেসার তিনি... কিন্তু দীর্ঘ এক যুগের পরে তাকে এখন আর দেখা যায় না বল হাতে দেখা যায় না বাংলার জার্সিতে... একবার আলোকপাত করা যাক অশোক দিন্দার ক্রিকেট জীবনের পরিসংখ্যানের ওপর
১৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১২টি উইকেট
৯টি আন্তর্জাতিক কুড়ি-২০ ম্যাচে ১৭টি উইকেট
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ১১৭টি ম্যাচে ৪২০টি উইকেট
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে ৭৮টি ম্যাচে ৬৯টি উইকেট
কিন্তু এই সবই তো হলো শুকনো পরিসংখ্যান, শুধু মাত্র তা দিয়ে অশোক দিন্দার ক্রিকেট জীবনকে মাপা সম্ভব নয়... পূর্ব মেদিনীপুরের অখ্যাত গ্রাম নৈছনপুর থেকে উঠে এসে বাংলা দল হয়ে ভারতীয় দলের নীল জার্সিতে জাহির খানের সাথে বোলিং ওপেন করার স্বপ্নের উড়ানের পথটা কিন্তু একদমই মসৃণ ছিল না... সোনার চামচ মুখে দিয়ে তিনি জন্মাননি, প্রতিটা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে অদম্য দুর্নিবার লড়াই করে তাকে উঠে আসতে হয়েছে এই জায়গায়... গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম... দারিদ্রতার অভিশাপে কৈশোর শেষ হবার আগেই যেখানে চেষ্টা করতে হয় রোজগারের, সেই প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়ে ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখা মানে বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়...
এই সব চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যে শৈশবেই তিনি বাবাকে হারান, যখন প্রথম শ্রেনীর ছাত্র অশোকের বয়স মাত্র ৭ বছর... তার পর থেকে মূলত মামাই তার অভিভাবক... প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই সেই মামার সঙ্গেই প্রথম বারের জন্য কলকাতা আসেন শহর দেখতে... নিয়তির অপার মায়ায় কলকাতার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার চোখ আটকে যায় একটা সবুজ মাঠে, যেখানে সাদা পোশাকের বেশ কিছু বিভিন্ন বয়সী ছেলে ক্রিকেট অনুশীলন করছিল... জোর করে মামাকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে দিয়ে, বায়না শুরু করলেন ওদের সাথে খেলতে চেয়ে... অনেক বার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও শেষে ভাগ্নের প্রবল জেদের কাছে হেরে গিয়ে, ওখানকার কোচকে অশোকের খেলার জন্য অনুরোধ করলেন মামা... সেটা ছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত ক্লাব টালিগঞ্জ অগ্রগামীর কোচিং ক্যাম্প, আর ওখানকার কোচের নাম ছিল অটল দেব বর্মন... কোচ তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে আদৌ বল করতে পারে কিনা, জীবনে কোন দিন ডিউস বলে হাত না দেওয়া অশোক অবলীলায় বলে দিলো - 'এখানে যতজন বল করছে, তাদের সবার থেকে আমি অনেক জোরে বল করতে পারবো'... দ্বিধাগ্রস্ত কোচ তাকে বল করতে পাঠালেন তার সমবয়সী বাচ্চাদের নেটে... হাওয়াই চটি পড়ে থাকা অশোক চটি খুলে খালি পায়ে দীর্ঘ একটা রান আপ নিয়ে দৌড় শুরু করল, শুরু হল যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা একটা নাছোড়বান্দা স্বপ্নের গল্প... কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক কোচ ১৫ মিনিটের মধ্যে তাকে ঐ বাচ্চাদের নেট থেকে সরিয়ে বড়দের নেটে পাঠাতে কার্যত বাধ্য হলেন, কারন তার তীব্র গতির বলে একের পর এক বাচ্চা আহত হচ্ছিল... অদ্ভুত ভাবে সেই নেটেও আগুন ঝড়া বোলিং শুরু করলেন অশোক, তাকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো ময়দানের একাধিক পোড় খাওয়া ব্যাটসম্যান... গভীর ক্রিকেট মনস্কতা দিয়ে অটল দেব বর্মন সেই দিনই বুঝতে পেরেছিলেন, সঠিক ভাবে পরিচর্যা করলে এই স্ফুলিঙ্গ একদিন দাবানলে পরিনত হবে...
তার মামার থেকে সরাসরি অশোক দিন্দাকে চাইলেন অটল বাবু... কিন্তু এখানেও সমস্যা, সুদূর নৈছনপুর থেকে অত সকালে রোজ কলকাতা পৌঁছানো অসম্ভব ব্যাপার... আর যে পরিবারে নূন্যতম অন্নসংস্থান নিয়েই সমস্যা আছে, তাদের পক্ষে কারোর কলকাতায় থাকার খরচ যোগান দেওয়া তো অলীক মরীচিকার মতো ব্যাপার... কিন্তু কবে - কখন - কোথায় - কার হাতে - কোন থালায় - কার জন্যে ভাত বাড়া আছে তা স্বয়ং অন্তর্যামীও জানে না...!!! নিজের পরিবারের সাথে প্রাথমিক ভাবে চূড়ান্ত সংঘাতে গিয়েও অশোকের কলকাতায় থাকা - খাওয়া - অস্তিত্ব রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন ক্রিকেট অন্ত প্রান অটল বাবু... তার পরের ব্যাপারটা অনেকটা স্বপ্নের মতো... ঠিক তার পরের দিন অটল স্যারের কিনে দেওয়া জুতো পড়ে সেই যে লাল টুকটুকে বল হাতে অশোকের দৌড় শুরু হল, যা আজও চলছে দুর্নিবার ভাবে...
২০০৫ সালে তার প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে অভিষেক হয় রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের হয়ে... তারপর থেকে আজ পর্যন্ত রঞ্জিতে বাংলার হয়ে নিয়েছেন মোট ৩৩৬টি উইকেট, যা বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ... এবং ধারে কাছে কেউ নেই, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রণদেব বসু তার থেকে মোট ১১৮টি উইকেট কম পেয়েছেন... দিনের পর দিন করে গেছেন দুরন্ত পারফরমেন্স, অনবদ্য বল করে ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৬ বার... কিন্তু তার পরেও এলো সেই অভিশপ্ত দিন, গত বছরের ২৪শে ডিসেম্বর তাকে কোন ভাবে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়... এটাই বোধহয় ছিল বল হাতে এতো দিন ধরে পরম আবেগের সাথে রাজ্যের সেবা করে যাওয়ার অন্তিম প্রতিদান... তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের... যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় রাজ্য ক্রিকেটের জন্য অপরিসীম অবদান রাখা এই একরোখা - গোঁয়ার ছেলেটাকে হয়তো একটু আন্তরিক সহনশীলতা ও ভালোবাসা দিয়ে বোধহয় নিয়ন্ত্রন করা যেত... যাই হোক এগুলো এখন অতীত, কারণ চরম অভিমানে দিন্দা ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তিনি বাংলাকে প্রবল ভাবে ভালোবাসা সত্বেও আর কোন দিন বাংলার হয়ে খেলবেন না...
এখানেই অশোক দিন্দার লাঞ্ছনার গল্পের শেষ নয়... আধুনিক সভ্যতার পৈশাচিক ব্যাধি সোশাল মিডিয়া ট্রোলের দ্বারাও খুব নিকৃষ্ট ভাবে আক্রান্ত দিন্দা... ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে যে কোন বোলার মার খেলেই, তাকে বলা শুরু হয়েছে "দিন্দা একাডেমীর" সদস্য... হ্যাঁ আই. পি. এলে দিন্দার ইকোনমি রেট ওভার প্রতি ৮.২... কিন্তু আমরা এটা খুব স্বচ্ছ ভাবে জানি, যে কুড়ি-২০ ক্রিকেট মূলত ব্যাটসম্যান দের দাপটের খেলা... এখানে বিভিন্ন সময়ে বল করতে এসে প্রচন্ড ভাবে মার খেতে হয়েছে শোয়েব আখতার, ডেল স্টেন, বুমরা, রাবাদা, প্যাট কামিন্স, মিচেল জনসন, ট্রেন্ট বোল্টের মতো বিশ্বখ্যাত সব মহাতারকা বোলার দেরও... ভাবতে অবাক লাগে তা সত্ত্বেও কেন বলির পাঁঠা করা হয় একমাত্র অশোক দিন্দাকে... মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি অস্তাচলে চলে গেছে আমাদের মহামূল্য স্পোর্টসম্যান স্পিরিট... কারন এক্ষেত্রে শুধু দিন্দাকে নয়, অপমান করা হচ্ছে তার মতো প্রান্তিক জায়গা থেকে উঠে এসে লড়াই করা সারা পৃথিবীর প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের স্পিরিটকে... তাই বোধহয় এই প্রসঙ্গে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার ইসুরু উদানা টুইট করেছেন - "কারোর বিরুদ্ধে কিছু বলার আগে, তার সম্পর্কে পুরো গল্পটা জানা উচিত"...
কিন্তু বঞ্চনার করুন ইতিহাস দিয়ে তো অশোক দিন্দার কাব্য শেষ করা যায় না... কারন দিন্দারা কোনদিন হারে না, হারতে পারে না... দুর্নিবার দিন্দারা পড়ে যেতে যেতেও তুমুল প্রাণশক্তি আর অদম্য বেয়াড়া জেদ নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়... কিন্তু তা আর হয়নি। তিনি এখন রাজনীতির ময়দানে খেলছেন।