মীরাবাঈ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, সংসারে থেকেও তার মন পড়েছিল জগৎ স্বামীর উপরে, তাই স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে তিনি ভগবানের উদ্দেশ্যে পথে পথে বেরিয়েছেন, অনেক কষ্ট ভোগ করে শেষে গিয়ে সেই পরম প্রিয়তমর দর্শন লাভ করেছিলেন, ভগবানও তার প্রাণ প্রিয় মীরাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু মীরার পাণি গ্রহণ করেননি ভগবান, অথচ এমন এক নারী আছে, যিনি মাটির পৃথিবীতে জন্মানোর পরেও তার সাধনায় খুশি হয়ে স্বয়ং ভগবান তার পাণিগ্রহণ করেছিলেন, ভক্তকে দিয়েছিলেন স্ত্রীর মর্যাদা। হ্যাঁ,বন্ধুরা আজকে এমন এক সাধিকার কথা বলবো, যিনি তার সাধনার মধ্য দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছিলেন, ভগবান স্বয়ং তার ভক্তিতে খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করেছিলেন,তিনি হলেন অন্ডাল।
দক্ষিণ ভারতের এক অখ্যাত গ্রামে বিষ্ণুচিত্ত নামের এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, সংসারের নানা কাজ কর্মের মধ্যে থেকে, ভগবানের নাম করতেন তিনি, ভগবানের বিগ্রহ সেবা, তুলসী দেবীর সেবা করেই তার দিন কাটত। একদিন হঠাৎই তুলসী বাগানের মধ্যে তিনি এক নবজাতক কন্যাকে কুড়িয়ে পান, সেই শিশুর পরিচয় কী এই চিন্তায় তিনি যখন চিন্তিত, তখনই দৈববাণী হয়, একে তোমার নিজের মেয়ের মতো করে লালন পালন করো। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বিষ্ণুচিত্ত সেই কন্যা সন্তানকে ঘরে নিয়ে আসেন আর তার স্ত্রী ও সাদরে সেই সন্তানকে গ্রহণ করেন।
সেই রাতেই বিষ্ণুচিত্ত স্বপ্নে নিজের ইষ্ট দেবতাকে দেখতে পান, তিনি ব্রাহ্মণকে জানান, "এই কন্যা স্বয়ং দেবী পৃথিবী, তোমার এত দিনের একনিষ্ঠ ভক্তির ফল রূপে ইনি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করলেন"। স্বয়ং ভগবতী বসুন্ধরা তার মেয়ে রূপে তার ঘরে এসেছে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভক্ত দম্পতির জীবন কাটতে লাগল, এরপর মেয়ে বড় হলে মেয়ের মুখে প্রথম কথা বের হয় -'বিষ্ণু'। মেয়ে যত বড় হতে থাকে, তত তার মুখ দিয়ে ভগবানের নাম করে সুর বের হতে থাকে, কেউ তাকে গাইতে শেখায়নি, কেউ তাকে কীর্তন শেখায়নি, তবুও যেন সে নিজে নিজেই একা একাই কীর্তন গাইতে থাকে আর সেই গান যেন বয়ে চলে যায় বৈকুন্ঠের দিকে, সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে যান স্বয়ং ভগবান। লোকের মুখে মুখে নাম প্রচারিত হতে থাকে, তিনি ‘অন্ডাল’। তার মুখে ভগবত প্রেমের কথা শুনতে লোক ছুটে আসে দূর দূরান্ত থেকে।যদিও তাঁর আসল নাম ‘ গোদাদেবী’
বিষ্ণুচিত্তের সংসার তো এমনিই ছিল ভগবতময় এখন অন্ডালের জন্য তা দেব মন্দিরে পরিণত হয়। সমবয়স্ক সঙ্গিনীদের অন্ডাল গোপী বলে ভাবে, তার মুখে একই কথা, কেউ কি তার শ্যামসুন্দর কে দেখেছ? কখন আসবেন তিনি? তার যে আর দিন কাটে না- এভাবেই সারাদিন ভগবানের নাম গানে, কাজে মগ্ন হয়ে থাকে অন্ডাল। ভগবানের জন্য ফুল দিয়ে মালা গাঁথে সে, সেই মালার মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকে তার হৃদয় ভরা ভালবাসা, মালা ভগবানকে পরিয়ে ভাবে বিভোর অন্ডাল ভাবে, এই মালা তার প্রিয়তমের গলায় মানাবে তো?- বিষ্ণুচিত্ত কে না জানিয়েই সেই মালা মন্দিরে পাঠানো হয় ভগবানের উদ্দেশ্যে, কিন্তু সেই মালা ফিরিয়ে দেন পুরোহিত।
বিষ্ণুচিত্ত কে ডেকে তিনি বলেন, 'তোমার আনা মালা টাটকা নয়, যেন আগেই কেউ এই মালা গলায় পরেছে!' দুঃখিত হন বিষ্ণুচিত্ত, ভেবে পান না এমনটা কীভাবে হতে পারে?- এরপর একদিন অন্ডাল মালা গাঁথার সময় বিষ্ণুচিত্ত দেখেন অন্ডাল নিজের গাঁথা মালা নিজেই গলায় পরছে-অবাক হন বিষ্ণুচিত্ত,কিছুই ভেবে পান না তিনি,দৌড়ে এসে মেয়েকে বলেন, “এ কী করছিস? দেবতার মালা নিজে গলায় পরছিস!”- সেদিন অন্ডালের গাঁথা মালা নয়, নিজে মালা গেঁথে নিয়ে আসেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু সেই রাত্রেই ইষ্ট দেবতা স্বপ্ন দেন, “কী মালা পরিয়েছ আমাকে? আমার প্রিয়তমার স্পর্শ যে মেলায় লেগে আছে তাতেই তৃপ্তি হয় আমার, অন্য মালা দেবে না আমাকে।”
এরপর স্বাভাবিকভাবেই অন্ডালের ওপর থেকে সামাজিক রীতিনীতি শাস্ত্রীয় বিধি সবকিছু আলগা হয়ে যায়, ঈশ্বর তন্ময়তায় দিন কাটতে থাকে অন্ডালের, এভাবেই একদিন বিষ্ণুচিত্তের কাছে বসে বসে সকল তীর্থের কথা শুনছিলেন অন্ডাল, তখন বিষ্ণুচিত্ত শ্রী রঙ্গনাথজীর কথা বলেন, রঙ্গনাথজীর কথা শোনার পর থেকেই অন্ডাল ভাবে বিভোর হয়ে যায়, রঙ্গনাথের সঙ্গে তার নিজের বিচ্ছেদ বেদনা সে যেন অনুভব করতে পারে, চোখের জল নিয়ে গাইতে শুরু করে অন্ডাল আর চোখের জল মেশা সেই গান গিয়ে পৌঁছায় দাক্ষিণাত্যের শ্রী রঙ্গনাথের মন্দির। শ্রী রঙ্গনাথ মন্দিরের আধিকারিকবৃন্দ একরাত্রে দৈববাণী লাভ করে, “আমার প্রিয়তমা অন্ডালকে অবিলম্বে আমার কাছে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো”- একই স্বপ্ন পান বিষ্ণুচিত্ত, স্বয়ং ভগবান শ্রী রঙ্গনাথ অন্ডালের পানি গ্রহণ করবেন, অন্ডালও স্বপ্ন দেখে রঙ্গনাথজীর সঙ্গে মহা আড়ম্বরে বিয়ে হচ্ছে তার! সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র ছড়িয়ে যায় সেই কথা, মাটির পৃথিবীর কন্যাকে বিয়ে করতে চাইছে স্বয়ং ভগবান!
এরপর? বাজনা বাজে, গান ওঠে, নৃত্যের তালে তালে পাগল হয়ে চলতে থাকে মানুষ অন্ডাল এর সঙ্গে বিবাহ যাত্রার পথে। মন্দিরে পৌঁছানোর পর দেখা গেল বধূবেশী অন্ডাল মিলিয়ে গেলেন তার প্রিয়তমের সঙ্গে,এক তীব্র জ্যোতির যেন বিচ্ছুরণ ঘটল দেবতার মূর্তি থেকে। অন্ডাল আর ভক্ত রইলেন না, তিনি আর সাধিকাও রইলেন না, নিজের ইষ্টের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন ঈশ্বরী!
জনশ্রুতি অনুযায়ী, মীরাবাঈও এভাবেই ভগবানের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়, কিন্তু অন্ডালকে বিবাহ করেছিলেন রঙ্গনাথ! অন্ডাল তাই হয়ে উঠেছিলেন রাধারানীর মতোই ভগবানের প্রিয়তমা,তাই তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেছিলেন ভগবান। তাই তো অন্ডাল দক্ষিণ ভারতের সকল ভগবত প্রেমিকের আরাধ্যা দেবী শ্রী রঙ্গনায়কী হয়ে উঠেছিলেন,আজও দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পালিত হয় অন্ডাল বিবাহ উৎসব।