অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্যকথা

'অক্ষয় তৃতীয়া' নিয়ে আজ যে গল্পটি শোনাব, সেটি বেদব্যাসের লেখা 'ভবিষ্য পুরাণ'-এ রয়েছে। চমৎকার গল্প। গল্পটি সেখানে বলা হচ্ছে ঋষি শতানীকের জবানিতে।


আসলে, ঋষি শতানীকের কাছে গিয়ে যুধিষ্ঠির একবার কথায় কথায় কৌতূহলী হলেন। জানতে চাইলেন, হে প্রাজ্ঞ, অক্ষয় তৃতীয়া তিথিকে লোকে যে পুণ্যতিথি বলে, এর কারণটা কী? 


তখন শতানীক কোন ভণিতা না-করে একটি গল্প বলতে শুরু করলেন। বললেন, শোন বৎস, কোন এক গ্রামে একজন বামুন ছিল। তার ধর্মেকর্মে একেবারেই মন ছিল না, মনে দয়ামায়ার লেশ ছিল না, ছেলেপিলের বালাই ছিল না, অবিশ্যি তার জন্য তার কোন হাপিত্যেসও ছিল না। 


তাহলে, তার ছিল কী?


অঢেল বিষয়সম্পত্তি ছিল, বেজায় কিপ্টেমি ছিল, সতী-সাধ্বী স্ত্রী ছিল, আর সেই স্ত্রীর একখানা নামও ছিল, 'সুশীলা'।

AkshayaTritiya1

সে-বার বৈশাখ মাসে এত গরম পড়ল যে, জলা-জলাশয় সব শুকিয়ে গেল, মাঠঘাটেরও চাঁদি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। দিনমানে ঘরে তিষ্ঠনো দায় হয়ে উঠল। বাইরে বেরনো হয়ে উঠল আরও দুষ্কর। 

ঠেলায় পড়ে তার মধ্যেও অবিশ্যি বেরুতে হল এক পথিককে। ফলে, পথ চলতে চলতে একসময় সে দারুন ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তেষ্টায় তার ছাতি ফাটতে লাগল, সেই সঙ্গে বেশ খিদেও পেয়ে গেল। অথচ, পথে জনপ্রাণিটি নেই, গাঁ-গঞ্জেরও দেখা নেই। এ তো মহা মুশকিল হল!

চলতে চলতে পথিক যখন নিতান্তই কাতর হয়ে পড়েছে, এমন অবস্থায় পথের একটা বাঁক ঘুরতেই সে খানিক দূরে একখানা গ্রাম দেখতে পেল। এতেই ধড়ে যেন তার প্রাণ এল। অমনি পা চালিয়ে সে-দিকেই সে রওনা দিল।


গ্রামের মুখেই বামুনের বাড়ি। ফলে, অল্পক্ষণেই পথিক তার উঠোনেই হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হল। 


দাওয়ায় বসা বামুনকে দেখে পথিক যেন হাতে চাঁদ পেল। কাতর স্বরে বলল, পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই, অনেকদূর থেকে আসছি, খিদে-তেষ্টায় প্রাণ আর বাঁচে না! দয়া করে একটু জল আর একটু খাবার যদি দেন, তাহলে এই গরীবের প্রাণরক্ষা হয়।

পথিকের কাতর প্রার্থনা শুনে বামুনের মনে কিন্তু কোন দয়া এল না। উল্টে খুব রাগ হল :  ইস, কোথাকার কে এলেন রে! এই দাও, সেই দাও--মামার বাড়ির আবদার! দয়ায় মজে সব বিলিয়ে দিয়ে সর্বশান্ত হই আর কী! রাগী রাগী ভাবনা শেষ হতেই পথিকের মুখের ওপর সটান বলে দিল, না বাপু, এ-বাড়িতে জল নেই, খাবারও নেই। তুমি অন্য জায়গায় ব্যবস্থা দেখ, এখানে সুবিধে হবে না।

পথিক এই ব্যবহার মোটেই আশা করেনি। সে হতাশ হয়ে করুণ চোখে খানিকটা হতভম্ব হয়েই যেন বামুনের দিকে চেয়ে রইল। বামুন তার দিকে ফিরেও চাইল না। আর কোন উপায় না-দেখে কাঁধের গামছায় মুখের ঘাম মুছে উঠোন ছেড়ে পথিক পথে নামল।

ওই পথ দিয়েই নেয়েধুয়ে অশথ গাছে গুড়-ছোলা দিয়ে জল ঢেলে বাড়ি ফিরছিল সুশীলা। পথিক উঠোন ছেড়ে পথে নামতেই তার মুখোমুখি হল। সুশীলা পথিকের শুকনো মুখ দেখেই বুঝল, কিছু একটা হয়েছে, বুড়ো বামুনের ভীমরতি তো তার জানতে বাকি নেই! সে শান্ত গলায় বলল, কী চাও বাবা?

পথিকের হতভম্ব ভাব তখনও কাটেনি। তবু সুশীলার শান্ত গলায় খানিক ভরসা পেয়ে সে জানাল, বেশি কিছু না মা, পানের জল আর সামান্য আহার! কিন্তু...

সুশীলা বলল, বুঝেছি। এসো বাবা, আমার সঙ্গে এসো।

AkshayaTritiya2

পথিকের বুকে আবার আশা-ভরসা জাগল। সে সুশীলার পিছন পিছন ফের বামুনের উঠোনে এসে জুটল। সুশীলার সঙ্গে পথিককে আসতে দেখে বামুনের গোমড়া মুখ আমসি হল। 

সুশীলা তাকে ঝাঁঝিয়ে বলল, বলি হ্যাঁ গো, তোমার না-হয় পরকাল চুলোয় গেছে, কিন্তু আমার তো সেই চিন্তা এখনো আছে না কি! আজ অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে খিদে-তেষ্টায় অস্থির অতিথিকে এই ভর দুপুরে শুধু মুখে বিদেয় করে আমার সে পথটাও কী জলাঞ্জলি দিতে চাও! একুল-ওকুল দু'কুল ভাসিয়ে যখের ধন নিয়ে খুব শান্তি, না?

সুশীলার কথার চোটে চটে উঠে চোটপাট করার লোক বামুন মোটেই নয়। সে বাক্যটি ব্যয় না-করে চুপচাপ উঠে পালিয়ে গেল। বামুন পালাতেই সুশীলা শান্ত হয়ে অতিথি সেবায় মন দিল।

প্রথমে পা ধোয়ার জল দিল। তারপর বসার আসন দিল, বাতাসা দিয়ে খাবার জল দিল, দুধ-খইয়ের ফলার দিল, মুখশুদ্ধির পান সেজে দিল।


বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে-দেয়ে পানটান চিবিয়ে খানিক জিরিয়ে পথিক সুশীলাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে বিদায় নিল।


দিনের পরে দিন গেল।


তারপর হঠাৎ একদিন সেই কিপ্টে বামুন কথা নেই বার্তা নেই দুম করে মরে গেল। যথারীতি শেষ বিচারের জন্য যমদূতেরা তাকে নিয়ে চলল যমপুরীতে। 

মর্ত থেকে যমপুরী, অনেক দূরের পথ। সে পথে পদে পদে কাদা, পদে পদে কাঁটা, পদে পদে কাঁকর। পথ বড় উঁচুনিচু। সহজে কিছুতেই শেষ হতে চায় না। তার ওপর রথ নেই, সমাদর নেই, কিচ্ছুটি নেই; যমদূতেরা বামুনকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।

সেভাবে পথ চলতে চলতে একসময় বামুনের খুব তেষ্টা পেল। ক্রমে ছাতি ফাটতে লাগল। অবস্থা এমন হল যে, একটু জল না-পেলে পা যেন আর চলে না! কিন্তু যমদূতদের সে-দিকে কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। সে আর না-পেরে হাতজোড় করে তাদের বলল, বাপু হে, দোহাই তোমাদের একটু জল না-খেয়ে আর যে হাঁটতে পারি না!

যেই না বলা, অমনি যমদূতেরা ভেংচি কেটে সমস্বরে বলল, ইস, জল না হলে আর পারি না! পথিককে যখন জল না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়েছিলি, তখন মনে ছিল না! পাপীষ্টি বুড়ো কোথাকার, কিছুতেই জল পাবি না!

তবুও বামুন কত অনুনয়-বিনয় করল, নাকে খৎ দিল, নিজের কান মুলল, শেষমেশ হাঁটতে না-পেরে মাথা ঘুরে পড়ে গেল; কিন্তু তাতেও যমদূতদের মন গলল না। তারা টেনে হিঁচড়ে ঘষটাতে ঘষটাতে বামুনকে নিয়ে গিয়ে হাজির করল যমের দোর পেরিয়ে একেবারে যমের কাছে।

AkshayaTritiya3

চোখের সামনে বামুনের দুরবস্থা দেখে যম যেন একেবারে হাহাকার করে উঠলেন। দূতদের কড়া গলায় ধমক দিতে শুরু করলেন, ওরে এ কী করেছিস তোরা! সোনার রথ নিয়ে যাসনি, মুখে জল দিসনি পর্যন্ত! ধর্মকর্ম সব ডোবাবি দেখছি! এক্ষুনি ওঁর মুখে জল দে, জল দে...!

যমের মুখে এমনধারা কথা শুনে যমদূতেরা তো অবাক। তারা বলল, ও যে বোশেখের দুপুরে অতিথির অপমান করেছে, প্রভু! জল না-দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে, ভয়ানক পাপ করেছে! ও জল পাবে কী করে, তেষ্টায় ধুঁকতে ধুঁকতে ওর যে আজন্ম নরকবাস হওয়ার কথা!

যমের আর তর সইল না। বামুনকে তেষ্টায় ছটফট করতে দেখে কারও অপেক্ষা না-করে সিংহাসন ছেড়ে ছুটে গেলেন। তারপর নিজের হাতে বামুনকে জল খাইয়ে দিলেন। 

বামুন একটু সুস্থ বোধ করলে পরে তবে গিয়ে দূতদের সংশয় মেটানোর সুযোগ পেলেন যম। বললেন, না রে বাপু, তোরা যা দেখেছিস, যা শুনেছিস; সেটাই শেষ সত্য নয়। ধর্মের পথ যেমন সহজ, তেমনি জটিল। তোরা দেখেছিস, বামুন অসহায় পথিককে দুরছাই করেছেন আর ওঁর স্ত্রী সুশীলা পথিকের সৎকার করেছেন। স্বভাবতই বামুনের মহাপাপ আর সুশীলার মহাপুণ্য হওয়ার কথা। সেই মুহূর্তে হয়েওছে তাই।

কিন্তু তোরা খেয়াল করিসনি, দিনটা ছিল বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া তিথি। একে বলা হয়, 'অক্ষয় তৃতীয়া'। এ-দিন মানুষ পুণ্যকাজ করে অক্ষয় পুণ্যের অধিকারী হয়। সতীর পুণ্যে পতিরও পুণ্য হয়। তাই বামুন পাপ করলেও স্ত্রীর অক্ষয় পুণ্যে তাঁর পাপ কেটে গেছে। অক্ষয় তৃতীয়ায় যে পুণ্য অর্জিত হয়, তার ফল পরিবারের সকলেই পায়। পরিবারের সকলকে ভাগ দিয়েও এই পুণ্যের কোন ক্ষয় হয় না।

যমের কথায় দূতদের জ্ঞানচক্ষু খুলল। বামুনেরও বোধদয় হল। সে নিজের ভুল বুঝতে পারল। তখন নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে যমকে বলল, প্রভু, আমি অবোধ মানুষ, দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলুন না আমার মতো পাপীতাপি মানুষ কোন কোন উপায়ে নিজগুণে অক্ষয় তৃতীয়ার এই অক্ষয়পুণ্য অর্জন করতে পারবে?

বামুনের এই আত্মসমর্পণ ও প্রশ্নে যম বেশ প্রসন্ন হলেন। তিনি বললেন, অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে স্নান, দান, জপ, হোম আর বিষ্ণুপূজা করলেই অক্ষয় পুণ্য লাভ করা যায়। যে এই পঞ্চবিধি মেনে ব্রতপালন করে, অন্তিমে তার বিষ্ণুলোকে স্থান হয়।

বলা বাহুল্য, সুশীলার অক্ষয়পুণ্যে বামুন পাপমুক্ত হয়ে কিছুদিন স্বর্গসুখ ভোগ করে আবার পৃথিবীতে জন্ম নিল। এ-জন্মে সে হল একজন মহাগুণী ও দানশীল পণ্ডিত।  স্ত্রীরূপে পেল সেই পুণ্যবতী সুশীলাকেই। এই জন্মে দানাদিধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে তারা দু'জনেই হয়ে উঠল ভগবান বিষ্ণুর অত্যন্ত প্রিয়। অন্তিমে তাই বিষ্ণুলোকবাসী হয়ে অনন্ত সুখানন্দে কাল কাটাতে লাগল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...