আভাসের কিশোর হয়ে ওঠার গল্প

আভাসের কিশোর হয়ে ওঠার গল্প। আপামর স্রোতার প্রিয় কণ্ঠস্বরের মালিক তিনি। তবে জীবনের শুরুতে তিনি গায়ক হতেই চাননি। হতে চেয়েছিলেন নায়ক। আর বড় ভাই অশোক কুমার ঠিক উল্টোটা। হতে চেয়েছিলেন গায়ক, হয়ে গেলেন নায়ক। ১৯২৯ সালে আগস্টের ৪ তারিখে ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর খান্ডওয়ার এক ছোট গলির ছোট্ট বাড়িতে জন্ম হয়েছিল কিশোর কুমারের। ভাইদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। বাবা আইনজীবী শ্রী কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি। বড় ভাই ভারতের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেতা শ্রী কুমুদলাল গাঙ্গুলি যাকে আমরা অশোক কুমার বলে চিনি। দাদামণি আর কিশোর কুমারের মধ্যে বয়সের ফারাক ছিল ১৮ বছর।
 
সেই দাদামণির স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছিল আভাস থেকে কিশোর হয়ে ওঠার প্রথম ধাপের কথা। ছোটবেলা থেকেই অন্যকে নকল করে দেখানোর শখ ছিল তার। সবার নকল করে বেড়াতেন তিনি। আর শখ ছিল ইওডেলিংয়ের, যেখানে বিভিন্ন পিচে সুর করে গাইতে হয়। প্রসঙ্গত, ভারতে কিশোর কুমারই প্রথম ইওডেলিং আনেন। শোনা যায়, একদম ছোটবেলায় তার গানের গলা ভাল ছিল না। কণ্ঠস্বর ছিল কর্কশ এবং মোটা। অশোক কুমার পরে বিভিন্ন জায়গায় বলেছিলেন, হঠাৎই একদিন খেলার সময় পা কেটে গিয়েছিল কিশোরের। তারস্বরে কান্নায় বাড়ি মাথা তুলেছিলেন। এক হুলুস্থুল পরিবেশ সৃষ্টি হল। কিশোরের মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় ছোট্ট কিশোরের কান্না থামল। কান্না থামার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি জিনিস এক্কেবারেই ভ্যানিস হল। কর্কশ স্বরের বদলে চলে এল সুরেলা কণ্ঠ। গলার স্বর এক মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে পরিণত হল। সেই কণ্ঠে বাঁধা পড়ল ভারতবাসীর মন। সেই কণ্ঠের যাদুতে আজও মোহিত দুনিয়া। আর ওই কান্না থেকেই কিশোর কুমারের সঙ্গীত জগতের দিকে পথ চলা শুরু।
 
kishorekumar1
 
১৯৪৮ সালে প্রথম 'জিদ্দি' চলচ্চিত্রে বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্র জগতে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন কিশোর। অজস্র ভাষায় অজস্র গান গেয়েছেন। শচিন কর্তা ও তাঁর জুটি আজও মিথ হয়ে আছে। নিজের সময় সবথেকে বেশি পারিশ্রমিক নেওয়া গায়ক হয়ে উঠেছিলেন কিশোর। কেবল গায়ক হিসেবেই নয়, ক্যামেরার সামনে অভিনেতা হিসেবে এবং লেন্সের নেপথ্যে পরিচালক হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। ১৯৫১ সালে 'আন্দোলন' চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে হাতেখড়ি হয় তাঁর। ১৯৫৪ সালের পর থেকে 'নউকরি', 'নিউ দিল্লী', 'আশা', 'চালতি কা নাম গাড়ি', 'হাফ টিকিট', 'পড়োসান', 'ঝুমরু', 'লুকোচুরি' ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই নিজের জন্য গান গেয়েছেন। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে 'চালতি কা নাম গাড়ি', 'হাফ টিকিট', 'পড়োসান' আজও বিখ্যাত। গানগুলোর সবই প্রায় বিখ্যাত। গানগুলোর মধ্যে তাঁর হাস্যরসাত্মক কাণ্ডগুলো যে কাউকেই অভিভূত করবে।
 
kishorekumar2
 
দেব আনন্দ আর রাজেশ খান্না, এই দুই নায়কেরই কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন কিশোর। আর বাংলায় উত্তমকুমারের, যদি সেটা মহানায়কের জীবনের শেষার্ধের ছবিগুলিতে। সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে বাবা ও ছেলে অর্থাৎ শচীনদেব বর্মন ও রাহুলদেব বর্মনের সঙ্গে কিশোরকুমারের ট্র্যাক রেকর্ড সবচেয়ে ভাল। ​কিশোর কুমার জীবনে তিনজনকে গুরু মানতেন। তারা হলেন, কে এল সায়গল‚ হলিউডি গায়ক-অভিনেতা ড্যানি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাড়িতে এই তিনজনের বড় বড় ছবিও রেখেছিলেন কিশোর। রোজ সকালে উঠে এই তিনজনকে প্রণাম করতেন কিশোর কুমার। ভারতবর্ষে পুরুষ নেপথ্য গায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ড আজও রয়েছে কিশোর কুমারের দখলে। মোট আটবার এই পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। 
 
কিশোর একটু খামোখেয়ালি মানুষ ছিলেন, নিজের মতো চলতেন। টাকার বিষয়ে একেবারে পেশাদারি। বহু ছবি ছেড়েছেন। বহু ছবির কাজ শেষ হয়নি। শোনা যায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় '‌আনন্দ'‌ ছবির নাম ভূমিকায় কিশোরকুমারকে ভেবেছিলেন। ঠিক হয়েছিল অভিনয় করবেন এবং গানও গাইবেন। অদ্ভুত কিছু শর্ত আরোপ করে শেষমেশ পিছিয়ে গেলেন কিশোর। পরে সেই চরিত্রে কাজ করলেন রাজেশ খান্না, চরিত্রটি আজও কালোত্তীর্ণ। অন্যদিকে, দিকপাল পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল কিশোরের। মানিক মামা বলে কিশোর সত্যজিৎকে ডাকতেন। কিশোরের প্রথম স্ত্রী ছিলেন রুমাদেবী,  সেই সূত্রেই মানিক বাবুর সঙ্গে কিশোরের সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। '‌পথের পাঁচালী'‌র জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন কিশোর। আবার চারুলতা ও ঘরে বাইরের জন্যে রবীন্দ্রনাথের কথায় কণ্ঠ দানও করেছিলেন কিশোর। সত্যজিত তাঁর দুটি ছবিতেই অভিনয়ের জন্যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিশোরকে। যদিও কিশোর দুটির কোনটিতেই কাজ করেননি। প্রথম ছবিটি ছিল পরশপাথর। শোনা যায়, পরেশবাবুর যুবক সেক্রেটারির চরিত্রে কিশোরকে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে সত্যজিত '‌গুপী'‌ চরিত্রের জন্যে একবার কিশোরই ভেবেছিলেন। গান এবং অভিনয় দুইই কিশোর করবেন বলেই ঠিক হচ্ছিল কিন্তু যা বাস্তবায়িত হয়নি।
 
kishorekumar3
 
​বিতর্কেও জড়িয়েছেন, জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষে পড়েছিলেন। পাঁচ বছর রেডিওতে তাঁর গান বাজেনি। কিন্তু দমেননি কিশোর। শিল্পীরা এমনই হন। গাড়ির খুব শখ ছিল, পাল্লা দিয়ে গাড়ি কিনতেন এমন উদাহরণও রয়েছে। বাড়ির নাম রেখেছিলেন মেন্টাল হসপিটাল, লিখে রেখেছিলেন কিশোর কুমার হইতে সাবধান। ভাবা যায়! বাঙালি কমব্যাক করতে এবং আরেক বাঙালির কমব্যাক গর্ব করে উপভোগ করতে খুব ভালোবাসে। কিশোরও প্রাত্যবর্তন করেছিলেন, রাজার মতোই আরাধনার গানগুলো দিয়ে ফের রাজার প্রত্যাবর্তন হয়েছিল। আজ তাঁর মৃত্যু এতো বছর পরেও, তাঁর গানের জনপ্রিয়তায় এক ইঞ্চিও ভাটা পড়েনি। এখনও পুজো থেকে জলসা, ফোনের প্লে লিস্ট থেকে আপন মনে গুনগুন; সর্বত্রই কিশোরময়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...