২৮, পারেখ মহল। মুম্বই- এর শিবাজি পার্ক এলাকার এই ঠিকানা সাধারণ চোখে বেশ অচেনা।
গত তিরিশ বছর ধরে এই এক চিলতে অফিসই অনেক অপরাধীর রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার ঠিকানা।
সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনের সময় এই ছোট্ট অফিসটাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের জরুরি গন্তব্য হয়ে উঠেছিল।
অপরাধীরা ভয় পায়। রাজনীতিবিদরা যাওয়া জরুরি মনে করে। ভাবছেন তো এ কীসের অফিস। সূত্র না দিয়ে শুধু ধাঁধার মত বলা যায় এ অফিস রজনী পণ্ডিতের।
মহারাষ্ট্রের আর পাঁচজন সাধারণ মহিলার থেকে আলাদা করে তাঁকে চেনা যায় না। কুর্তি কামিজ,
আর কয়েন সাইজ মেরুন বিন্দিতে তিনি আপাদমস্তক ভারতীয় নারী।
কিন্তু তাঁর চরিত্রটি বিলকুল মিলে যায় এক বিদেশি মহিলার সঙ্গে। সারা বিশ্বের গোয়েন্দা গল্প প্রেমিদের কাছে তিনি দারুন জনপ্রিয়। অনেকেই স্বপ্ন দেখে তাঁর মত হওয়ার। কিন্তু রজনী কখনও কারোর মত হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। তবু তিনি ভারতের ‘মিস মার্পেল’। রজনী পণ্ডিত। ভারতের প্রথম মহিলা ‘প্রাইভেট ডিডেকটিভ’। ১৯৮০ সাল থেকে শিবাজি পার্কের এই অফিস থেকেই সারা দেশে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে আসছেন।
উত্তেজনায় টানটান মুহূর্ত। রগের পাশ ঘেঁষে ছিটকে যাওয়া গুলি। তবু সে উত্তেজনাকে সামলে রেখে অসম্ভব ঠান্ডা মাথা। রহস্যের জট খুলতে ক্ষুরধার মগজাস্ত্র। বিচক্ষণতার প্যাঁচে ধুলোবালি থেকেও টেনে বের করে আনতে পারেন অপরাধীর সূত্র। গোয়েন্দাদের এভাবেই ভাবতে ভালবাসে পাঠক।
গোয়েন্দা বললেই আমাদের প্রথমেই মাথায় আসে ফেলুদা, ব্যোমকেশ কথা। কিংবা কাকাবাবু, কিরীটী। মহিলা গোয়েন্দাদের মধ্যে মিস মার্পেল, বড় জোড় মিতিন মাসি।
এই সীমাতেই আটকে আছি আমরা। পেশাদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে মেয়েরা সব সময়ই মাঠের বাইরের দর্শক। টানটান উত্তেজনা জিইয়ে রেখে খুনে-অপরাধী ধরবে। অপরাধীকে ধাওয়া করতে করতে পার হয়ে যাবে বালিয়াড়ি, বেনারস। কিংবা মগনলালের আস্তানায় যাচ্ছে কোনও মেয়ে গোয়েন্দা এমন ভাবনা আজও অনেক ক্রোশ দূরে।
কিন্তু কেউ কেউ ভেঙে দিতে জানেন প্রচলিত ধারনা্র বাঁধ। গতে বাঁধা ভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে হাঁটতে পারেন বিপরীত স্রোতে।
স্রোতের বিপরীতে তিনি হেঁটেছেন। ছোটবেলায় নেহাত অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ছুঁড়ে দেওয়া ‘স্পাই গার্ল’ থেকে আজকের ‘ মিস মার্পেল’।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে প্রায় ২২ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গোয়েন্দাগিরি। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৮০,০০০ কেসের সফল সমাধান করেছেন। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার।
রজনী বলেন, “ভারতীয় সমাজ এখনও ভাবতেই পারে না মেয়েরা ডিটেকটিভ হবে।”
মহারাষ্ট্রের থানে জেলার পালঘর নামে এক ছোট শহরের মেয়ে রজনী পণ্ডিত। সেখানেই জন্ম। বেড়ে ওঠা। বাবা শান্তিরাম পণ্ডিত ছিলেন মুম্বই পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটর।
গোয়েন্দাগিরি প্রথম শুরু করেছিলেন স্কুল পড়ার সময় থেকে। তাঁরই এক সহপাঠী বদ সঙ্গে পড়ে নেশায় জড়িয়ে পড়ছিল। স্কুলের পর সে কোথায় যায় জানতে তার পিছু নিয়েছিলেন রজনী। সেভাবে উদঘাটন করেন সহপাঠীর রহস্য। সহপাঠীর বাড়িতে জানিয়েছিলেন তার নেশায় জড়িয়ে পড়ার কথা। প্রমাণ হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন কিছু ছবি। সেই প্রথম নিজের ‘স্পাই গার্ল’ বিশেষণ্টা কানে এল।
পরের ঘটনা ২২ বছর বয়সে। তখন কলেজের ছাত্রী। পাশাপাশি তিনি একটি অফিসে পার্টটাইম চাকরি করতেন। ক্লারিক্যাল জব। সেই অফিসেই তাঁর এক মহিলা সহকর্মীর বাড়িতে একবার চুরির ঘটনা ঘটে। সেই মহিলা তাঁর সদ্য বিবহিত ভাইয়ের স্ত্রীকে সন্দেহ শুরু করে। কিন্তু তার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। সহকর্মীর মুখে সবটা শুনে রজনী নিজে থেকেই ‘তদন্ত’ শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় জিনিস খোয়া জাওয়ার মূলে মহিলার ছেলে। সেই চুরির কান্ড ঘটিয়েছিল। জেরার মুখে ভেঙে পড়ে।
রজনীর মতে শুধু বুদ্ধি নয়, গোয়েন্দাগিরিতে চাই প্যাশন।
বাবা মুম্বই পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটর হওয়ার কারণে অপরাধী চেনার নানা গল্প শুনতে পেতেন। সে সব শুনে শুনে অপরাধী সনাক্তকরণের নানা দিক জানা হয়েছিল রজনীর।
একটা দুট কেস সমাধান করার পরই নাম ছড়াতে শুরু করে। প্রতিবেশি, চেনা জানাদের কাছে থেকে অপরাধ ও রহস্য সমাধানের জন্য অনুরোধ আসতে লাগল।
একটা সময় পর রজনী বুঝলেন পেশা হিসেবে নেওয়াই যায় গোয়েন্দাগিরিকে। ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ হিসেবে শুরু করলেন নিজের কেরিয়ার। তৈরি করলেন রজনী ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো। তাঁকে কাজে সাহায্য করার জন্য নিজের টিম আছে। প্রায় ২০-২৫ জন সদস্য সেই টিমে।
সাদামাটা বেশ, আটপৌরে চেহারা রজনীর প্লাস পয়েন্ট। ভিড়ে মিশে অপরাধী ধরতে সুবিধা হয়। ছদ্মবেশ নিতেও দারুন পারদর্শী।
একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, “অ্যা ডিটেকটিভ ইজ বর্ন। নট মেড।” অর্থাৎ গোয়েন্দারা জন্মায়। তাদের তৈরি করা যায় না। রজনী বিশ্বাস করেন এই প্রবাদে।
রহস্য সমাধান কীভাবে করতে এই এটা কেউ পুরোপুরি হাতে ধরে শেখাতে পারে না। নিজের ইন্টেলিজেন্স, স্মার্টনেস আর ভাবনা দিয়েই সমাধানের সূত্রগুলো খুজে পাওয়া সম্ভব। শুধু অভিজ্ঞতাটাই বলা যায়।
রজনী পণ্ডিতের জীবন নিয়ে বলিউডে ছবিও তৈরি হয়েছে।‘ববি জাসুস’ নামে সেই ফিল্মে বিদ্যা বালনকে দেখা গিয়েছিল রজনীর চরিত্রে।
নিজের তদন্ত করা নানান ঘটনা আর রহস্য সমাধানের অভি়জ্ঞতা নিয়ে রজনী দুটো বইও লিখেছেন। ‘ফেসেস বিহাইন্ড ফেসেস’ আর ‘মায়াজাল’। প্রথম বইয়ের জন্য দুটি পুরস্কার এবং দ্বিতীয় বইয়ের জন্য ছ’টি পুরস্কারও পেয়ে গিয়েছেন রজনী।