হেদোর সামনে সিমলে স্ট্রিট। সেখানে ওস্তাদের বাসা। ওস্তাদ, কানাইলাল ঢেরী। তাঁর এ-অঞ্চলে বেশ ভালোই নামডাক। শেখান, এসরাজ। তবে, বাড়ি গিয়ে গিয়ে শেখানো তাঁর পোষায় না, শিখতে হলে তাঁর বাড়িতেই আসতে হয়। অবন ঠাকুরের খুব শখ, এসরাজ শিখবেন। এবং, কানাইলালের কাছেই শিখবেন। বেশ, সে না হয় হবে 'খন। কিন্তু, তার জন্য তো সিমলে স্ট্রিটে ঢেরীর বাড়ি যেতে হবে। তা, যেতে হলে, হবে। জোড়াসাঁকো থেকে সিমলে স্ট্রিট, পথ আর কতটুক। তাছাড়া, ঠাকুরবাড়িতে জুড়ি-ছ্যাকড়ার তো অভাব নেই। সুতরাং, দেরি হল না। অবন ঠাকুরের এসরাজ-শিক্ষা বহাল তবিয়তেই শুরু হয়ে গেল।
অবনের মনে বড় বাজিয়ে হবার দারুণ শখ; অথচ কিছুতেই স্বরেতারে আঙুল সেট হচ্ছে না। তায় আবার আঙুলের ওপর দিয়ে যখন-তখন ছড় টেনে ফেলছেন। এই করে করে একদিন আঙুলে কড়া পড়ে গেল, তবু যন্তর থেকে সুর বেরুলো না। সতীর্থরা সবাই তাঁকে টপকে এগিয়ে গেলেন। কেবল অবনেরই কোন উন্নতি হল না। শিষ্য যখন হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় দেখছেন না; তখন ওস্তাদের রোখ চাপল। তিনি মোটেই ছাড়বার পাত্র নন। কারণ, চ্যালা হচ্ছে বড়বাড়ির ছেলে, প্রণামীদক্ষিণাও জোটে ভালো। এমন বাড়ির ছেলে না-শিখে হতাশ হয়ে ফিরে গেলে আখেরে তাঁরই তো বদনাম! ফলে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। জোর কদমে সাধনা চলল। এবং তাতেই একদিন অবনের হাত থেকে সুর বেরলো 'অ্যা-ও' করে। তবে, হাতে সুর এলেও মনে এলো না। মানে, কেউ গান গাইলে সুর ধরে রাগরাগিনী বুঝে পাকা হাতে বাজিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পেলেন অবন। কিন্তু, নিজে সুর সৃষ্টি করবেন, এমন শিক্ষা পেলেন না। সে যাইহোক, প্রথম গুণটির জন্যই কিছুদিনের মধ্যে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর কিন্তু বেশ সুনাম হল।
রবীন্দ্রনাথ এদিকে তখন জোড়াসাঁকোয় তাঁর সাহিত্যিকশিল্পী ও গুণীবন্ধুদের নিয়ে তৈরি করে ফেললেন 'খামখেয়ালি' সভা। নিয়ম করে সভার অধিবেশনে গানবাজনার আসর বসতে লাগল, আর তাতে নিয়মিত এসরাজ বাজাতে লাগলেন অবন ঠাকুর। এইভাবে ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক পরিমণ্ডলটির তিনি যখন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছেন, তখনই একদিন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকলেন। বললেন, সঙ্গে এসরাজ নিয়ে আসতে। অবন কাকার ডাকে এলেন, এসরাজ বাগিয়েই এলেন। রবীন্দ্রনাথ নতুন গান তৈরি করবেন। তিনি এক এক লাইন গান লিখবেন আর সুর দিয়ে গাইবেন। সেই সুর ধরে ধরে তাঁর সঙ্গে অবনকে এসরাজ বাজাতে হবে। বেশ। শুরু হল লেখা, গাওয়া, বাজানো। একসময় এমনি করে পুরো গানটি শেষ হল। বেশ হল। অবনেরও ছুটি হয়ে গেল। কিন্তু, এর মধ্যেই একটা অঘটনের সূত্রপাত হয়ে গেল...
আসলে, অঘটনটা ঘটল ঠিক পরের দিন, যখন অবনকে রবীন্দ্রনাথ আবার ডাকলেন। এবং, এসরাজে আগের দিনের সুরটি বাজাতে বললেন, তখন। অবন তো আকাশ থেকে পড়লেন, সেই সুর মনে করে বাজাতে হবে নাকি! মনে তো নেই। শুধু সুর কেন, তাল-মাত্রা-রাগ-রাগিনী কিচ্ছু মনে নেই। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁকে মনে রাখতে বলেননি! তিনি তো মনের আনন্দেই বাজিয়ে গেছেন শুধু, মনে রাখার কথা যে মনেও আসেনি! এদিকে মুশকিলের ওপর মুশকিল--সেই গানের সুর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও মনে নেই। সুর ভুলে যাওয়ার বদঅভ্যেস তাঁরও আছে! রবীন্দ্রনাথ সুর দেন আর বাজিয়ে সেটা মনে রাখেন, রবিকাকার গান লেখার যে এটাও একটা ধরন, সে তো আর অবন জানতেন না! কিন্তু, এখন কি হবে! উপায় কী! অভয় দিলেন রবীন্দ্রনাথ। কী আর হবে। তিনি বলে, কত কত শোক পার করছেন, সুরের শোক তো কোন ছার। হেসে বললেন, 'আবার আমাকে খাটাবে দেখছি!'
গানের সেই প্রথম দেওয়া সুরটি হারিয়ে গেল তো গেলই। সে আর দুজনের কারুরই কোনদিন মনে পড়ল না। রবীন্দ্রনাথ নতুন করে গানটির সুর দিলেন। সে একেবারেই অন্য সুর। অবন ঠাকুর চিরকাল নিজেকে দোষ দিয়েছেন সুরটি হারিয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু, বয়সকালের 'ঘরোয়া' স্মৃতিকথায় চরণ উদ্ধৃত করে গানটিকে চিনিয়ে দেননি। যদি দিতেন, তাহলে বেশ হত। হয়ত, এটাও তাঁর বয়সকালের আর একটা ভুল--গানটির প্রসঙ্গ তাঁর মনে ছিল, কথাগুলো সম্ভবত বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন!--এরকম ভেবে নেওয়া ছাড়া আজ আর কোন উপায় নেই..