রাজা দক্ষের ছিল শতসহস্র কন্যা। ইতোমধ্যেই এক বা একাধিক কন্যাকে তিনি এক এক দেবতা ও ঋষির হাতে সম্প্রদান করে ফেলেছেন। বাকি ছিলেন কনিষ্ঠা কন্যা সতী, শেষমেশ তাঁকেও সম্প্রদান করলেন দেবাদিদেব মহাদেবের হাতে। সমগ্র দেব ও ঋষিকুলের শ্বশুর দক্ষ অহংমত্ত হয়ে এরপর থেকেই সবার কাছে প্রভূত সম্মান পাবার প্রত্যাশা করতে শুরু করলেন। আর এটাই তাঁর কাল হল।
স্বর্গে দেবতারা সে-বার যজ্ঞ করছেন, শিবসহ সমস্ত দেবতা উপস্থিত। সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে দক্ষও এলেন। তিনি আসতেই সমস্ত দেবতা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে প্রণাম করলেন। শুধু ভোলানাথ শিব করলেন না। শিব যে ইচ্ছে করে প্রণাম করলেন না এমন নয়, তিনি খেয়ালের ঠাকুর, ভাবের রাজ্যে ছিলেন, তাই দক্ষের আসার ব্যাপারটা একেবারেই খেয়াল করেননি। কিন্তু, দক্ষ ভাবলেন শিব ইচ্ছে করেই তাঁকে সবার সামনে উপেক্ষা করে অপমান করলেন। আর তাতেই তাঁর ভয়ানক রাগ হল শিবের ওপর। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি অভিশাপ দিলেন যে, সমস্ত দেবতারা যজ্ঞের ভাগ পাবেন, কিন্তু, মহাদেব কোনদিন পাবেন না! এমন একটা অভিশাপ দেওয়ার পরও শিব নত হয়ে তাঁর পায়ে পড়লেন না। তাতে দক্ষর জ্বালা আরও বেড়ে গেল। তিনি তলে তলে শিবকে নিদারুণ অপমান করার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই দক্ষ বৃহস্পতিযজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেই যজ্ঞে তিনি সমস্ত দেবতাদের আমন্ত্রণ জানালেও শিবকে জানালেন না। পিতার এই কাণ্ডে সতী অবাক হলেন, কিন্তু নারদের মুখে সব শুনে বুঝলেন, পিতা অহংয়ের বশে অকারণে স্বামীকে ভুল বুঝেছেন। তখন সেই ভুল ভাঙাতে শিবের অনুমতি নিয়ে নন্দীকে সঙ্গে করে পিতার ভবনে তিনি উপস্থিত হলেন। যজ্ঞ সবে শুরু হয়েছে, চলছে দারুণ শিবনিন্দাও। সতীকে আসতে দেখলেন দক্ষ। দেখেও, কন্যাকে আদর-অভ্যর্থনা তো জানালেনই না; উপরন্তু তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে শিবকে ভিখারি, বেহায়া, নির্লজ্জ বলে অত্যন্ত কটুভাষায় গালাগালি করতে লাগলেন। পতিব্রতা সতী পতিবিরুদ্ধ এসব নিন্দাবাক্য কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর শত অনুনয়েও দক্ষ থামলেন না। পিতার এই আচরণে সতী দারুণ আঘাত পেলেন, প্রাণও আর রাখতে ইচ্ছে করল না! তখন সঙ্গে সঙ্গে যোগ-অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে যজ্ঞস্থলে সকলের সামনেই তিনি প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই অঘটন ঘটে যেতে দেখে নন্দী প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, তারপর কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন কৈলাসে। তাঁর মুখে সতীর আত্মবিসর্জনের এই সংবাদ শুনে শিব যেন পাগল হয়ে গেলেন। ছিঁড়ে ফেললেন জটার চুল। তা থেকে জন্ম নিল, অনুচর বীরভদ্র। প্রবল বিক্রমে শিবের অন্যান্য অনুচরদের নিয়ে গিয়ে সে যজ্ঞস্থল লণ্ডভণ্ড করে মুণ্ডপাত করল দক্ষের।
আর শিব? তিনি সতীর মৃতদেহটি কোলে তুলে বিলাপ করতে লাগলেন পাগলের মতো। দু'চোখে বইতে লাগল অশ্রুধারা। তাঁর মনে হল, যে-জগতে সতী নেই, সেই জগতের কোন প্রয়োজন নেই! সব লয় হোক! প্রলয় হোক চরাচর! তখন সতীর দেহটি কাঁধে তুলে উঠে দাঁড়ালেন ভোলানাথ, শুরু করলেন প্রলয়কারী তাণ্ডব নাচ।
সেই প্রলয়নৃত্য থামিয়ে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য শিবের কাছ থেকে সতীকে আলাদা করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং বিষ্ণু। তিনি তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ একান্নটি অংশে খণ্ডিত করে দিলেন। সেই অংশমালা একে একে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল ধরণীর নানা প্রান্তে। সেই প্রান্ত-প্রদেশসমূহে কালে কালে গড়ে উঠল দেবী সতীর এক একটি পীঠ।
সতীর দেহ শিবের কাঁধ থেকে সরিয়ে দিতেই শিব অনেকটা শান্ত হলেন বটে। কিন্তু তাঁর রুদ্রতেজ কম হল না। সেই তেজের প্রভাবে সূর্য মুমূর্ষু হয়ে গেলেন। সেই তেজের আগুনে যে পথে শিব গমন করেন সে-পথের বৃক্ষ-পাহাড়-জনপদ সব ভস্ম হয়ে যেতে লাগল। তখন 'ত্রাহি ত্রাহি' করতে করতে এই রুদ্রতেজ প্রশমণের উপায় খুঁজতে দেবতারা গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা বললেন যে, একটাই উপায় আছে। আর সেজন্য চাই অমৃতের কলস ও ষোলকলাময় চন্দ্র।
তখন অমৃতের কলস এলো, ষোলকলায় সেজে চন্দ্রও এলেন। রাত্রিকালে তিনি যে শীতলতা আর প্রশান্তি নিয়ে আকাশে অবস্থান করেন; সেই শীতলতা ও প্রশান্তি অমৃতের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে অনুরোধ করলেন ব্রহ্মা। তখন ব্রহ্মার প্রার্থনায় চন্দ্র অমৃতের কলসে প্রবেশ করলেন। তারপর সেই অমৃতের কলস নিয়ে দেবতারা শিবের কাছে গেলেন, প্রার্থনা জানালেন সেই অমৃত গ্রহণ করার জন্য। অমৃত দেখে শিব প্রসন্ন হলেন। কিন্তু, কলসে আঙুল ডুবিয়ে যেই সুধা তুলতে গেলেন, অমনি তাঁর নখের আঘাতে কলসে থাকা চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলেন। দেবতারা একযোগে 'হায় হায়' করে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। চাঁদের ষোলকলার মহিমা অষ্টকলায় বিভক্ত হয়ে গেল যে! দ্বিখণ্ডিত চাঁদ শোকে মুমূর্ষু হয়ে পড়লেন। তখন শিব উপলব্ধি করলেন তাঁকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য চাঁদের আত্মত্যাগের কথা। আর সেটা বুঝেই প্রসন্ন হয়ে তিনি চাঁদকে ষোলকলার গৌরব অক্ষুন্ন থাকার আশীর্বাদ দিলেন। আর খণ্ডিত অষ্টকলাকে মহীয়ান করে তুলতেই শিব তা শিরে ধারণ করলেন। অমনি শিবের সমস্ত শরীর প্রশান্তিতে ভরে উঠল। সমস্ত দুঃখ যেন প্রশমিত হল নিমেষে। তারপর থেকেই চিরকাল প্রশান্তির প্রতীকরূপে শিবের শির-শোভা হয়ে রয়ে গেল সেই আধখানা চাঁদ।
গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ'