গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত, 'বামন পুরাণ'
'শিব পুরাণ' ও 'লিঙ্গ পুরাণ'-মতে আদিতম দেবতা শিব; তিনিই অন্য সব দেবতার স্রষ্টা। কিন্তু 'বামন পুরাণ'-মতে আদিতম দেবতা হলেন বিষ্ণু। তাঁর ইচ্ছেতেই শিব এবং ব্রহ্মার জন্ম হয়েছিল। কীভাবে হয়েছিল? বলছি :
সৃষ্টির আদিতে যখন চারিদিকে শুধু জল আর জল, আর কিচ্ছুটি নেই; তখন সেই জলের উপর অনন্তশয্যায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথম দেহীরূপে আবির্ভুত হলেন বিষ্ণু। কিন্তু, অল্পদিনেই সেই খাঁ খাঁ ত্রিভুবনের চরম একাকীত্ব পেয়ে বসল তাঁকে। মন পেতে চাইল সঙ্গী। তখন তিনি তাঁর তমোগুণ থেকে শিব আর রজোগুণ থেকে ব্রহ্মা- এই দুই দেবতাকে সৃষ্টি করলেন।
বিষ্ণুর ইচ্ছেয় ব্রহ্মা আবির্ভুত হলেন পাঁচটি আনন বা মুখমণ্ডল নিয়ে। সেইজন্য তাঁকে বলা হতে লাগল, 'পঞ্চানন'। পঞ্চমুখী হয়ে তাঁর অহংকারের অন্ত রইল না। চারটি দিকে ব্যাপ্ত চার মুখে শাস্ত্রকথা বললেও পঞ্চম মুখটি দিয়ে তিনি শিব-নিন্দে শুরু করলেন। মুখটি তাঁর মাথার উপর অবস্থিত।
ব্রহ্মার শিব-বিদ্বেষ ও নিন্দার একটাই কারণ, শিবকে ছোট করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা। বিষ্ণুর সৃষ্টিতে তিনিই যে শ্রেষ্ঠ, এটা প্রমাণ করা। তাই সময় নেই অসময় নেই 'অসভ্য বাঘছালধারী', 'এক-মুন্ডী'-- বলে শিবকে উপহাস করতে লাগলেন। আপাত-শান্ত শিব অবশ্য উদাসীন হয়ে ক্রমাগত সে-সব উপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু, এই উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে একদিন ব্রহ্মা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করলেন; ভিখারি বলে, মূর্খ বলে, অক্ষম বলে, নিকৃষ্ট তমোগুণ-জাত বলে শিবকে বারবার অপমান করতে লাগলেন। তখন শিব আর কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না, অসম্ভব রেগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধারণ করলেন 'পঞ্চানন' রুদ্রের বিনাশকারী রূপ। সেইসঙ্গে সাদা, লাল, সোনালি, নীল ও পিঙ্গল--এই পাঁচ বর্ণের পাঁচটি মুখ উদ্ভূত হল তাঁর কাঁধে। তৃতীয়-নয়ন থেকে বেরুতে লাগল আগুনের গোলা। তাঁকে রাগিয়ে দিতে পেরে ব্রহ্মা যেন আরও মজা পেলেন, প্রবল উৎসাহে পঞ্চম মুখ দিয়ে নিন্দের বন্যা বইয়ে দিতে লাগলেন। তখন রুদ্ররূপী শিব প্রচণ্ড একটি হুঙ্কার ছেড়ে বাঁ-হাতের নখ দিয়ে ব্রহ্মার সেই নিন্দুক মুখটি খুলি অর্থাৎ করোটিশুদ্ধ উপড়ে নিলেন। অমনি অসম্ভব যন্ত্রণায় ব্রহ্মার পাগলপারা অবস্থা হল, তিনি চিৎকার করতে করতে ত্রিভুবন জুড়ে ছুটতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও শান্তি পেলেন না। অন্যদিকে ব্রহ্মাকে শাস্তি দিয়ে শিবও স্বস্তি পেলেন না। তাঁর হাতে আঁঠার মতো আটকে গেল সেই করোটি। কিছুতেই হাত থেকে সেটা আর মুক্ত করতে পারলেন না! তখন তিনি নিরুপায় হয়ে ছুটলেন স্রষ্টা বিষ্ণুর কাছে। চোখের সামনে দুই অঙ্গজের বিরোধ দেখে বিষ্ণু তখন নিতান্তই অসুখী এবং অসন্তুষ্ট হয়ে বসে ছিলেন। এই অবস্থায় অসহায় শিব বিষ্ণুর কাছে হাজির হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। জানতে চাইলেন এই করোটি থেকে মুক্তির উপায়।
অবশেষে বিষ্ণুর উপদেশে শিব বারাণসীধামে এসে গঙ্গায় স্নান করে বসলেন এক কঠিন তপস্যায়। তাঁর দীর্ঘ ত্যাগ ও তপস্যায় একদিন বিষ্ণু তুষ্ট হলেন। তাঁর আশীর্বাদে শিবের হাত থেকে খসে পড়ল ব্রহ্মার করোটি, তিনি মুক্ত হলেন। কিন্তু, শিব নিজে মুক্ত হলেও করোটিকে মুক্তি দিলেন না। তিনি ব্রহ্মার হীনতা ও কৃতকর্মের কথা চিরকাল স্মরণ করিয়ে দিতে, অন্যায়ের দমনকারী, ভোগ-ব্যসনত্যাগী দেবতা হিসেবে ভক্তের মনে জায়গা করে নিতে, সেই করোটিকে নিজের পান ও আহারের পাত্র করে নিলেন। করোটির আর এক নাম, 'কপাল'। তাই এই 'কপাল' ধারণ করার পর শিবের নাম হল, 'কপালী'। শিবের অনুসরণে এখান থেকেই শিব-উপাসক 'অঘোরী'-সম্প্রদায় পানাহারের পাত্র হিসেবে 'নর-কপাল'-কে গ্রহণ করেছে।