আজ বাঙালির নববর্ষ, নতুন বছর মানেই খানাপিনা, নতুন পোশাক, সঙ্গে থাকে হালখাতার মিষ্টিমুখ। পয়লা বৈশাখ মানে বাংলা বছরের প্রথম দিন। নববর্ষের এই দিনে পুরোনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে, নতুন বছরকে বরণ করা হয়। সেই প্রথা মেনেই
বৈশাখের দিনে হালখাতার প্রচলন। ব্যবসায়ীরা সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে, পুরোনো হিসেবের খাতা বন্ধ করে নববর্ষের দিন নতুন হিসেবের খাতা খোলে। লাল রঙের এই খাতায় নতুন বছরের সবরকম পাওনা গন্ডা, হিসেব নিকেষ লিখে রাখা হয়। নববর্ষের
শুভ মুহূর্ত থেকেই হালখাতার সূচনা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গাব্দের সূচনাও হয়। দোকানিরা হালখাতা নিয়ে পুজো দিতে ছোটেন। আজ নববর্ষ মানেই হালখাতা কিন্তু আদপে হালখাতার সঙ্গে নববর্ষের কোন সম্পর্কই ছিল না।
প্রকৃতি অর্থে হালখাতা কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এক আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীনকালে হাল কিংবা লাঙল দিয়ে চাষের নানা দ্রব্য-সামগ্রীর হিসেব করা হত, বিনিয়োগ সবকিছুই একটি খাতায় লিখে রাখা হত, এটিকেই বলা হত হালখাতা। তাহলে নতুন বছরের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ভাবে হল? সংস্কৃত ভাষায় হালের অর্থ লাঙল, কিন্তু ফরাসিতে এর অর্থ নতুন। লাঙলের ব্যবহার শেখার পর মানুষ স্থায়ীভাবে কৃষিকাজ শুরু করে। কৃষিজাত দ্রব্য বিনিময়ের প্রথা শুরু হয় তখন থেকেই। এই লাঙল বা হালের মাধ্যমে চাষের ফলে উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্রী বিনিময়ের হিসেব একটি খাতায় লিখে রাখা হত। সেই খাতার নাম ছিল হালখাতা। হাল শব্দটি
সংস্কৃত ও ফরাসি— দুটি থেকেই এসেছে। সংস্কৃতে হল বা হালের অর্থ লাঙল এবং ফরাসিতে হাল শব্দের অর্থ নতুন। সময়কাল বিশেষে দুটি অর্থই হালখাতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রাচীন কালের হালখাতার মতোই জমিদারদের কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য পুণ্যাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। একই নিয়ম মেনে যা বাংলাতেও প্রচলিত ছিল। একদা এদিন খাজনা বা রাজস্ব পরিশোধ করতেন সকলে। প্রাচীন কালের হালখাতা নবাবী আমলে নাম পাল্টে হয় পুণ্যাহ। কিন্তু পরবর্তী কালে হালখাতা নামটিই প্রচলিত হয়ে পড়ে।
সুবে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর আমল থেকেই হালখাতার সূচনা হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্যই এই হালখাতার প্রচলন করেন নবাব। নতুন বছরে প্রথম দিনে খাতার প্রথম পাতায় লাল সিঁদুরের স্বস্তিক চিহ্ন একেই সূচনা করা হয় নতুন খাতা বা হালখাতার।
আবার অনেকেই বলেন সম্রাট আকবর হালখাতার উৎসবের প্রচলন করেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী, নতুন বছরের প্রথম দিন ফসল কর আদায় বা রাজস্ব আদায়ের প্রচলন হয়। হিন্দু সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা এবং ইসলামি চন্দ্রমাস হিজরী সালের সমন্বয়েই মুঘল
রাজ জ্যোতির্বিদ এই দিনটি নির্ধারণ করেছিলেন, তারপর থেকেই এইদিন হালখাতা উৎসব অথবা তৎকালীন সমাজে পুণ্যহ বলে পরিচিতি পায়। এদিন বাংলার প্রতিটি প্রান্তে সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো হয়, ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে পুজো করা হয়। অতিথিদের মিষ্টি, আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেন না ব্যবসায়ীরা। সাধারণত দিনের এদিনের অমৃতযোগেই হালখাতা লেখার নিয়ম। নববর্ষের দিনে দোকানে দোকানে লেখা হয় হালখাতা। নতুন বছরের হিসেব নিকেশ শুরু হয় পয়লা বৈশাখ থেকে। বঙ্গাব্দের সূচনা কালে নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে হালখাতার কোনও সম্পর্ক না থাকলেও পরবর্তী কালে নববর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে হালখাতা লেখার ঐতিহ্য।
হালখাতা আদপে রাজস্ব আদায়ের আরেক নাম। সেই আমল থেকেই চৈত্র মাসের শেষে রাজস্ব পরিশোধ করে দেওয়ার রীতিটি প্রচলিত ছিল। প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতেন। এরপর দিন
অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূস্বামীরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। তারপর নববর্ষের দিনে শুরু হত নতুন হিসেব নিকেশ। সেই রীতি মেনেই এখনও পুরনো বছরের হিসেব মিটিয়ে নতুন বছরের হিসেব লেখা শুরু হয়।
হালখাতা নামে ওই রীতিই এখনও বাংলার প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে পালিত হয়।
ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই 'হালখাতা' শব্দটি। কিন্তু কিভাবে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে হালখাতার যোগ হল? ইতিহাস বলছে, পুরনো কলকাতায় ইংরেজি নববর্ষের উৎসব উপলক্ষ্যে বেশ ঘটা করে উৎসব পালন করা হত। কবি ইশ্বচন্দ্র
গুপ্ত ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন,
"খৃস্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমাননন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।
চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর।
নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা ঘর।"
সেই সময় বাংলা নববর্ষকে নিয়ে উৎসব বা আনন্দ কিছুই তেমন হত না। বাঙালিরা খুবই সাদা মাটা ভাবে কয়েকটি পুজো করত। 'চড়ক পার্ব্বন' নকশায় বাংলা নববর্ষের কথায় লেখা হয়েছে, " ইংরেজরা নিউ ইয়ারে বড় আমোফ করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে নেনে। আর বাঙালিরা বছরটা সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরানকে বিদায় দেন। কেবল কলসি উচ্ছূর্গ কর্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বছরকে মনে রাখেন।" স্বভাবতই এই লেখা থেকে বোঝা যায়
হালখাতার কথাই এখানে বলা হচ্ছে। তবে সে সময় যে নববর্ষ উৎযাপনে তেমন আড়ম্বর ছিল না, তাও স্পষ্টত জানা যায়।
এরপরে একেবারে আদিমযুগের কথা হাল এল যখন মানুষ কৃষিকাজ শিখল। বর্বর বাদুড়ে অবস্থা থেকে সে সভ্য হল, আর হালখাতা শব্দের উত্তরণের কথা তো আপনারা জানলেনই।
আমরা এখন যে ১লা বৈশাখকে নববর্ষ বা বছরের শুরু হিসেবে পালন করি, তার প্রচলন কিন্তু শুরু হয় ৩১৯ সালে। সেই সময় থেকেই পাঁজি গণনার শুরু। এর আগে বছরের গণনা শুরু হত হিম বা শরৎ কাল থেকে। ঋতু হিসেবে বছর গণনা করেতেও দেখা যায়।তবে পঞ্জিকা গণনার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির পয়লা বৈশাখের শুরু না হলেও, উৎসব পালনের শুরু হয়। আর হালখাতা পয়লা বৈশাখের আরেক নাম। বর্তমান রীতিটি অক্ষত, যার সামর্থ নেই, সামান্য কিছু দিয়েও খাতা খোলার রীতি এখনও রয়েছে। পয়লা
বৈশাখ মানেই হালখাতা অর্থাৎ নতুন বছরের শুরু। তবে ইতিহাস বলে 'হালখাতা' পয়লা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়েছে পড়েছে অনেক পড়ে। এর সঙ্গে সবচেয়ে প্রথম পরিচয় ঘটে বিনিময় প্রথার যুগে, সে সময় পয়লা বৈশাখের কোনও চল ছিল না। কিন্তু আজ বাঙালি হালখাতাকেই বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম করে ফেলেছে।