মাথায় সাদা টুপি। সাদা পোশাকে সমাহিত মুখ। ধীর, স্থির। জলে ভেসে বেড়ানো এক মেয়ে। মৃত্যু তাঁকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে বারবার। কিন্তু জীবন তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। এভাবেই জীবন-মৃত্যুর নৌকোয় চেপে বারবার জীবনের হাতছানিতে এগিয়ে গেছেন এই জাহাজ-সেবিকা। ভায়োলেট জেসপ। বিশ শতকের তিনটে জাহাজডুবির পরও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি।
১৮৮৭ সালে আর্জেন্টিনায় জন্ম ভায়োলেট জেসপের। জেসপের জীবন-মৃত্যুর দোলাচলের গল্প শুরু হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। তাঁরা আট ভাইবোন ছিলেন। জেসপের ছোটবেলাতেই তাঁর পরিবার আর্জেন্টিনা থেকে আয়ারল্যান্ডে চলে এসেছিল। তাঁর আট ভাইবোনের মধ্যে ছয় জন মারা যায় খুব কম বয়সেই। এদিকে আয়ারল্যান্ডে এসেই জেসপের টিউবারকুলোসিস অর্থাৎ যক্ষ্মা ধরা পড়ে। ডাক্তাররা প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন পরিবারকে। এমনকি বড় হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে বলা হয়েছিল আর মাত্র কয়েক মাস আয়ুকাল রয়েছে আর জেসপ-এর। কিন্তু জীবনের রূপকথা মাঝে মাঝে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। এই কঠিন অসুখ জয় করে জেসপ। সেরে ওঠে সে।
কিন্তু মাত্র পনেরো বছর বয়সেই পিতৃহারা হন ভায়োলেট। পরিবার তখন কর্পদকশূন্য। কাজের খোঁজে তাঁরা চলে আসেন ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডে এসে জেসপের মা জাহাজসেবিকা হিসেবে শুরু করেন তাঁর কর্মজীবন। এভাবেই পরিবারকে প্রতিপালন করতে চেয়ে ছিলেন তিনি। মা বেরিয়ে গেলে জেসপ তখন তাঁর ভাই বোন এবং সংসারের খেয়াল রাখতে শুরু করে।
বেশ চলছিল জীবন। এদিকে আরও একটা লড়াই অপেক্ষা করেছিল জেসপের জন্য। জেসপের মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। জেলর তখন যুবতী। পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট্ট কাঁধে। মায়ের পথই অনুসরণ করে মেয়ে। জাহাজ-সেবিকা হয়ে যোগদান করে 'আরএমএস অলিম্পিক' জাহাজের যাত্রায়।
জেসপ মিষ্টি, সুন্দরী ছিলেন। এদিকে জাহাজে সুন্দরী সেবিকাদের নিয়োগ হত না তখন। কোনভাবে যদি নাবিকের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। ইন্টারভিউয়ের দিন স্থির হল। জেসপ সেদিন সেজেছিলেন প্রসাধনহীন ভাবে। সাধারণ পোশাকে গেলেন। আসলে যে কোনওভাবে কাজটা তাকে পেতেই হত। নিযুক্ত হলেন জাহাজসেবিকা হিসেবে।
১৯১০ সালে বিলাসবহুল জাহাজে চড়ে নিজের কর্মজীবনের যাত্রা করেছিলেন জেসপ। ১৯১১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর আরএমএস অলিম্পিকের চতুর্থ যাত্রায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়ে এই জাহাজ। একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এর সঙ্গে ধাক্কা লাগে আরএমএস অলিম্পিকের। তেমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি জাহাজে থাকা যাত্রীরা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্বয়ং জাহাজ। এদিকে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েও একটুও ভয় পায়নি জেসপ। শোনা যায় তার পরেও হাসি মুখের আবার যাত্রীসেবিকা হিসেবে যোগদান করেন আরএমএস টাইটানিকের যাত্রাপথে। প্রথমদিকে এই জাহাজসেবিকার ইচ্ছে ছিল না আরএমএস টাইটানিকে কাজ করার। এক বন্ধুর কথায় খানিকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই যাত্রায় পাড়ি দেন।
অবশেষে আসে সেই ভয়ঙ্কর দিন। ১৯১২ সালের ১৪ই এপ্রিল একটি হিমবাহের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় টাইটানিক জাহাজ। ২২২৪জন জাহাজ যাত্রীর মধ্যে মারা যায় ১৫০০ যাত্রী। দুর্বিষহ এই পরিস্থিতিতে কাজ করে চলেন ভায়োলেট জেসপ। জেসপ ঘুমোচ্ছিলেন যখন টাইটানিকের সঙ্গে হিমাবাহের ধাক্কা লাগে। নিজের স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন, “জাহাজের ডেকে তাঁকে ডাকা হয়, যাত্রীদের ধীরে ধীরে সরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছিল, একজন মহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, জেসপ সেই মহিলাটিকে বাঁচাবার জন্য এগোচ্ছেন এমন সময় একজন জাহাজের কর্মী তাঁর কোলে একটা পুঁটুলি ছুড়ে দেন, সেই পুঁটুলির মধ্যে তিনি দেখেন, একটা ছোট্ট শিশু।”
এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন জেসপ হয়তো জাহাজ-সেবিকার জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। কিন্তু এতোটুকু নড়চড় হয়নি তাঁর কাজে। নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থভাবে তিনি সেবা করে গেছেন মানুষের। ওই শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রায় আট ঘণ্টা তাকে সামলেছিলেন জেসপ। শিশুটির মা তারপর জেসপের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই শিশুকে। বিনিময়ে সামান্য ধন্যবাদটুকুও দেননি।
এই ধরনের জাহাজ দুর্ঘটনা রীতিমতো আতঙ্ক জাগিয়েছিল এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মনে। এমনকি সমুদ্রযাত্রা অনেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। জেসপ তবে ছিলেন অবিচল। এরপরেও যাত্রী সেবিকার কাজ করতেন তিনি।
এরপরে এইচএমএইচএস ব্রিটানিক জাহাজও দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। এখানে সেবিকা ছিলেন জেসপ। এটি একটি যুদ্ধজাহাজ ছিল। মূলত যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রূষা করা হতো এই জাহাজে। এই জাহাজ দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। জেসপ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন দুর্ঘটনা ঘটার পরে বেশ খানিকক্ষণ হুঁশ ছিল না জেসপের। তারপর জ্ঞান ফিরতে তেমনভাবে কিছুই বুঝতে পারেননি নিজের শারীরিক অসুবিধা। আবার শুরু করেছিলেন তখন আহত সৈন্য যাত্রীদের সেবা। তবে বেশ কয়েকবছর পর ভীষণভাবে মাথা যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়েছিলেন জেসপ। পরে চিকিৎসার সময়ে দেখা যায়, তাঁর করোটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ওই দুর্ঘটনায়।
এত কিছুর পরেও জাহাজ-সেবিকা ছেড়ে যাননি তাঁর কাজকে। জল-পরীর মতো আগলে রেখেছিলেন মানুষদের। ৬৩ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন এই কাজ থেকে। ৮৪ বছর বয়সে মারা যান জেসপ। এই যাত্রী-সেবিকা আজীবন শুধু বিলিয়ে দিয়েছেন, নিজের মমতা, মায়া, ভালোবাসা। ইতিহাসের পাতায় এই নাম সেই ভাবে না পাওয়া গেলেও, প্রকৃত অর্থেই এঁদের জীবন বাঁচার অনুপ্রেরণা। সার্থক তাঁর নাম 'মিস আনসিংকেবল'।