বালকের পিঠে বাঁধা এক মরা শিশুর ছবি, ঝড় তুলেছিল বিশ্বে

নেড়া মাথা। বিধ্বস্ত চোখ মুখ। ছেঁড়াজামা কাপড়। খালি পা। কাঁধ থেকে পিঠে বেল্ট দিয়ে বাঁধা একটি ছোট্ট শিশু। দেখলে মন হবে ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট ভাই বা বোনটি যাতে পড়ে না যায় তার জন্য তাকে পিঠে বেঁধে রেখেছে সে। শক্ত করে আছে চোখ মুখ।

IMG-20230809-WA0012

আপাত দৃষ্টিতে দেখলে ছবিটি এই কথাই বলবে। দেখে মনে হবে অতি সাধারণ এক পাহাড়ী বালকের ছবি। নজরকাড়ার মতো তেমন কোনও বিশেষত্ব ছবিতে নেই। এক ঝলক তাকিয়ে ফিরে চলে যাওয়াই যায়। কিন্তু যদি বলা হয় বালকের পিঠে বাঁধা এক মরা শিশু, তখন ছবিটি আর নিরীহ থাকে না!

১৯৮০ সালে গোটা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল এই ছবি। ফটোগ্রাফার ও’ডনেল। এ ছবি নাগাসাকির। পরমাণু হামলার কয়েক মাস পর তোলা।

১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় বোমা হামলার মাস দু-এক পরে নাগাসাকি শহরের কোনও এক জায়গায় ছবিটি তুলেছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীতে কর্মরত ফটোগ্রাফার, মেরিন সার্জেন্ট জো ও’ডনেল।

IMG-20230809-WA0014

কিউশু দ্বীপের উত্তরাঞ্চলে একই বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল আত্মসমর্পণের পর জাপানের সব রকম যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলার সচিত্র দলিল ধরে রাখার জন্য। তিন মাসের কিছু কম সময় কিউশু দ্বীপের সাসেবো শহরে তিনি অবস্থান করেছিলেন এবং সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কয়েকবার নাগাসাকিতে গিয়ে বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির ছবিও তুলছিলেন।

সে সময় বেশ কিছু শশ্মান তৈরি হয়েছিল আপদকালীন ভিত্তিতে। তেমনি এক শ্মশানের কাছে তিনি এই বালকের দেখা পেয়েছিলেন।

২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা। মৃত ভাই বা বোনকে পিঠে নিয়ে বালকটি দাঁড়িয়ে ছিল। একধারে একা। তার মুখে কান্না কষ্টের কোনও অনুভূতি ছিল না। পরমাণু বিস্ফোরণে পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছিল সম্ভবত। তাই মৃত শিশুটির সৎকারের জন্য তাকেই আসতে হয়েছিল। দেহ এভাবে পিঠে বেঁধে।

সৎকারের ভিড়ে সেই বালক দেহ নিয়ে প্রায় ১০ মিনিট দাঁড়িয়েছিল এভাবে। অপেক্ষা করছিল তার পালা আসার জন্য। একসময় সাদা মাস্ক ঢাকা শ্মশান কর্মীরা এসে তার কাঁধের বেল্ট খুলে মৃতদেহটি নিয়ে যায়। বালক তাদের সঙ্গে এসে কয়লার আগুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। শিশুর দেহ গ্রাস করে আগুন। বালক দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে। যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল সে ঠায় দাঁড়িয়ে।

তারপর একসময় সে অন্য পথে হাঁটা দেয়। একবারও ফিরে তাকায়নি আর।

ছবির ফটোগ্রাফার জাপানি ভাষা জানতেন না। তাই বালকের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। সে তাঁর আফসোস ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।২০০৭ সালে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারেও তিনি বালকের কথা জানিয়েছিলেন।

তাঁর দেওয়া তথ্য নিয়ে অনেকেই সেই শিশুর খোঁজ পরিচয় পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সন্ধান মেলেনি তার, তবে পৃথিবীর বুকে ভয়াবহ হিংসার দলিল হিসেবে এই ছবি অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

১৯৪৫ সালের ৬ এব‌ং ৯ অগস্ট দুই জাপানি শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে দু’টি পরমাণু বোমা ফেলে আমেরিকা। যে প্রকল্পে ওই পরমাণু বোমার জন্ম হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট।’ বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে হয় এই প্রজেক্ট।

হিরোসিমার কথা বার বার আলোচনায় আসলেও নাগাসাকি যেন ভুলে যাওয়া এক শহরের মতো।

হিরোশিমা শহরে ওপর নেমে এসেছিল ‘লিটিল বয়’-এর অভিঘাত। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছিল ছবির মতো সুন্দর শহরটা। যুদ্ধ আর হিংসার ভয়ঙ্করতম চেহারা দেখে শিহরিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব।

হিরোশিমায় বিস্ফোরণের ঘোরের মধ্যে ফের আরও এক ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। আর একবার। ‘লিটিল বয়’  বিস্ফোরণের ঠিক ৩ দিন পর জাপানের অপর শহর নাগাসাকির ওপর ফেলা হল ‘ফ্যাটম্যান’।

তিনিয়ন দ্বীপ থেকে বি-টোয়েন্টি নামে একটি বিমান দ্বিতীয় আনবিক বোমাটি নিয়ে নাগাসাকির উদ্দেশে রওনা হয়। এ বোমাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ফ্যাটম্যান। বোমাটি ছিল গোলাকার প্লুটোনাম ক্ষেপণাস্ত্র।

সন ১৯৪৫। নাগাসাকি শহরে ৯ আগস্ট বেলা ১১টা ২ মিনিটে বোমাটি মাটি থেকে ৫০০ মিটার উপরে বিস্ফোরিত হয়। হিরোশিমায় ফেলা ‘লিটিল বয়’-এর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল ‘ফ্যাট ম্যান'। সেই অ্যাটমিক বোমার শক্তি ছিল ২০ কিলোটন অব টিএনটি। তার পরেই, ১৫ অগস্ট, আমেরিকার কাছে নিঃশর্ত সমর্পণ করার কথা ঘোষণা করে জাপান।

বিস্ফোরণের দিন নাগাসাকিতে মুহুর্তের মধ্যে পুড়ে ঝলসে শেষ হয়ে গিয়েছিল ১ লক্ষ ৩৫ হাজার প্রাণ। আহত আরও ৭৪ হাজার মানুষ। বোমার তেজস্ক্রিয়তায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় শিশুদের মাথার চুল৷ শিশুরা খাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে যুঝে মৃত্যুমুখী হয়। ১৯৫০ সাল নাগাদ আণবিক বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষে পৌঁছে যায়৷

ম্যানহাটন প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ক্যানসার এবং অন্যান্য জটিল রোগে ভুগে পরবর্তী পাঁচ বছরে আরও দু'লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। আণবিক বিস্ফোরণে আহত হয়েও যারা প্রাণে বেঁচে যায় তাদের ‘হিবাকুশা’ বলে ডাকা হত। নাগাসাকি শহর নতুন করে গড়ে উঠলেও নাগরিকদের ভয়, আতঙ্ক, মানসিক সংকট বয়ে চলেছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহ স্মৃতিতে গড়ে তোলা হয়েছে নাগাসাকি অ্যাটমিকবম্ব মিউজিয়াম। ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া দুই শহরের পরিণতি দেখে এক জোট হয়েছিল পৃথিবীর ত্রস্ত হয়েছিল শান্তিকামী মানুষ। শান্তির বার্তায়, সুস্থ পৃথিবীর লক্ষ্যে আজও চলছে সেই লড়াই..

তথ্য ঋণঃ Searching for the Standing Boy of Nagasaki

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...