পার্বতীকে বিবাহের জন্য কীভাবে পর্বতরাজ হিমালয় এবং মাতা মেনকাকে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন শিব?

শিব পুরাণে শিব চেতনা ও জ্ঞানসংহিতার অন্তর্গত অষ্টম অধ্যায় শিবের বিবাহ থেকে উল্লেখ করা আছে, শিবের বিবাহের অনুমতি ও প্রস্তুতি পর্বের কথা। দেবী পার্বতী নিজ তপস্যার বলে প্রসন্ন করেন আশুতোষ মহাদেবকে। এরপর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে মহাদেব দেবী পার্বতীকে দর্শন দিলে দেবী পার্বতী তাঁকেই স্বামী হিসেবে প্রার্থনা করেন। এই বরপ্রাপ্ত হয়ে খুশি মনে পার্বতী হিমালয়ের ঘরে গেলে শিব সপ্তর্ষিগণকে স্মরণ করলেন। সপ্তর্ষিগণ তখন কাশীধামে শিবের কাছে এসে উপস্থিত হলেন ও মহাদেবকে বললেন যে, ‘হে প্রভু আজ আপনি আমাদের কৃপা করে স্মরণ করায় আজ আমরা ত্রিভুবনে মান্য ও পুজ্য হলাম। মুনিদের মধ্যে উচ্চপদে আরোহন করলাম। এইভাবে আপনি আমাদের সম্মান বাড়ালেন। আপনি সর্ব বিষয়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত। আপনার তো কোন কিছুরই অভাব নেই। তবু যদি আপনার কোন কার্য সম্পাদন করবার থাকে তবে ভৃত্যগণকে আদেশ করুন।"

সপ্তর্ষীর কথা শুনে মহাদেব বললেন ঋষিগণ সর্বদাই পূজ্য‌। এই জন্যই আমি তোমাদের স্মরণ করেছি। আমার পরোপকার স্বভাবের কথা তোমরা জানো। সম্প্রতি তারকাসুর দেবতাগণকে অতিশয় পীড়া দিচ্ছে।‌ ব্রহ্মার কাছ থেকেও দুর্লভ বর লাভ করে মদমত্ত হয়ে উঠেছে সে। আমার মূর্তি অষ্ট এবং তিন বলে প্রসিদ্ধ। এইসব মূর্তি পরের হিতের জন্য আমার নিজের জন্য নয়। একমাত্র আমার পুত্র ছাড়া ত্রিভুবনের আর কেউ বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মা তারকাসুরকে এই বর দিয়েছেন। এই দেব কার্যসিদ্ধির জন্য আমি পার্বতীকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেছি শুধু যে আমি ইচ্ছা করেছি তা নয় পার্বতী ও আমাকে পতি রূপে লাভ করার জন্য ঋষিগণের মতো দুষ্কর তপস্যা করেছিলেন। আমি তার হিতের জন্য তার অভীষ্ট এই বিবাহ রূপ বর দান করেছি। অতএব তোমরা অবিলম্বে পর্বতরাজ হিমালয়ের দিকে গমন করো। সেখানে গমন করে হিমালয় ও তার পত্নীকে বলবে আমি তাদের কন্যাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেছি। কথাটা এমন ভাবে বলবে যাতে উত্তমরূপে কার্যসিদ্ধি হয়। এই বিবাহ কার্য যে দেবগণের স্বার্থ ও হিতের জন্য তোমরা সে কথা তাদের বুঝিয়ে বলবে। তোমরা সকলেই ব্যক্তি যোগ্য। তোমাদের কী আর বলব?"

সেই ঋষিগণ মহাদেবের এই কথা শুনে ভাবতে শুরু করলেন যে যিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর আরাধ্য সেই ভগবান দেবাদিদেব শম্ভু দেবগণের হিতের জন্য আমাদের এক সুখকর কার্যে নিয়োগ করছেন। এই মহাদেব জগতের স্বামী ও উমা বা পার্বতী হলেন জগৎ জননী। এইবার তারা হিমালয়ের রাজধানীর উদ্দেশ্যে গমন করলেন। হিমালয়ের রাজধানীর শোভা দেখে তারা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তারা নিজেদের মধ্যে হিমালয়ের অপরূপ শোভার কথা বলাবলি করতে করতে পর্বতরাজের গৃহে গমন করলেন পর্বতরাজ হিমালয় গৃহে সপ্তর্ষিদের আসতে দেখে হিমালয় পত্নী মেনকাকে বললেন," দেখো দেখো প্রিয়ে সাতটি সূর্য কি কারণে আমার গৃহের দিকে এগিয়ে আসছে? আমরা যখন গৃহস্থ্য তখন অতিথি অভ্যাগতদের সেবা ও পূজা করা আমাদের কর্তব্য। আমরা হচ্ছে গৃহস্থাশ্রমী। আমরা এক দিক দিয়ে ধন্য। কারণ আশ্রমবাসী ঋষিগণও আমাদের সেবায় সুখ প্রাপ্ত হন।"

এরপর সপ্তর্ষিগণকে সসম্মানে প্রণাম করে গৃহের ভেতরে নিয়ে এলেন হিমালয় রাজ। ঋষিগণ তার হাত ধরে তাকে মধুর সম্ভাষণ করে বললেন, আজ আমার গৃহ ধন্য হল আমার জীবন হল সার্থক মহা পূজ্য সপ্তর্ষি আমার গৃহে আগমন করাই তীর্থের মতোই আমি দর্শনীয় বস্তু হলাম। কারণ আপনারা বিষ্ণুর স্বরূপ আপনারা সকল বিষয়েই পরিপূর্ণ আমার মত দরিদ্র ব্যক্তির গৃহে আমার প্রতি অনুগ্রহব বসতই আগমন করেছেন সাধু ব্যক্তিদের আগমনে দরিদ্রদের গৃহ পবিত্র ও সমৃদ্ধ হয়। তথাপি আপনাদের কোন কার্য সাধনে আমার মত অযোগ্য ব্যক্তির যদি কিছু মাত্র যোগ্যতা থাকে তবে আমাকে আদেশ করুন আমি যথাসাধ্য তা সম্পাদনের চেষ্টা করব।"

গিরিরাজের এই কথা শুনে ঋষিগণ বললেন," হে হিমবান তোমার কন্যা পার্বতীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবাদিদের মহাদেব তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেছেন এই বিষয়ে তিনি বিধিমত তোমার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। বিবাহের পর তিনি দেবতাদের উপকার ও তাদের দুঃখ দূর করবার জন্য পুত্র উৎপাদন করবেন। শিব জগতের পিতা ও গুরু সুতরাং তোমার কন্যা জগৎজননী হবেন। আর তুমি হবে সেই জগৎ গুরুর গুরু।"

ঋষিদের কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন হিমালয়। তিনি বললেন,"হে ঋষি সপ্তক, যিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর আরাধ্য সেই দেবাদিদেব ভগবান শংকর আমার কন্যাকে পত্নী রূপে বরণ করে নেবেন এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। আমি হৃষ্ট চিত্তে বিবাহে অনুমতি দান করলাম তবে এই বিষয়ে আমার স্ত্রী মেনকার অনুমতি গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য। কারণ তিনি কন্যার মাতা।" এই কথা শুনে ঋষিগণ বশিষ্টের পত্নী অরুন্ধতীকে মেনকার কাছে গিয়ে শিবের সমস্ত অভিলাষের কথা বলতে অনুরোধ করলেন এবং গিরিরাজের পত্নী মেনকার কাছে অরুন্ধতী অনুমতি প্রার্থনা করতে গেলেন। মেনকা এই বিবাহে অনুমতি প্রদান করলে তখন আনন্দিত হয়ে ঋষিগণ হিমালয় থেকে কাশীধামে শিবের কাছে ফিরে গেলেন।

দেবাদিদেব মহাদেবের মুখ থেকে সমস্ত কথা শুনে বললেন “তোমরা আমার বিবাহে পৌরোহিত্য করবে হে ব্রহ্মবিদ ঋষিগণ তোমরা আমার বিবাহ কার্যসম্পাদন করবে।” ঋষিরা এই কথা বলে তথাস্তু বলে অঙ্গীকার করে নিজে নিজে স্থানে প্রস্থান করলে দেবাদিদের মহাদেব বিবাহ কার্যের প্রস্তুতি করবার জন্য কাশী থেকে কৈলাসে গমন করলেন। কৈলাসে গিয়ে তিনি নারদকে স্মরণ করলেন, দেবর্ষি নারদকে স্মরণ করা মাত্রই তিনি এসে উপস্থিত হলেন তিনি শিবের মুখে সমস্ত কথা শুনে আনন্দিত হলেন। নারদ বললেন, "ভক্তের বশীভূত হওয়ায় তো আপনার ব্রত। হে দেব, পার্বতীকে তার অভিপ্রেত বরদান করে তার সম্যক হিত সাধন করেছেন আপনি। এখন হে প্রভু আমাকে কী করতে হবে আজ্ঞা করুন?" শিব বললেন," তুমি যথার্থই কাজের কথা বলেছ তোমাকে এখন একটি কাজ করতে হবে। তুমি ব্রহ্মা বিষ্ণু, ইন্দ্র ও সমস্ত দেবগণকে নিমন্ত্রণ করবে। সমস্ত মাতৃগণ, যজ্ঞ ও গন্ধর্ব্যদের নিমন্ত্রণ করবে। যারা এই নিমন্ত্রণ পেয়েও আসবে না, তারা আমার আত্মীয়ের মধ্যে গণ্য হবে না।"

এরপর সকল দেবগণদেরকে পৃথক পৃথকভাবে নেমন্তন্ন করে আবার শিবের কাছে ফিরে এলেন নারদ। অন্যদিকে শিবের বিবাহের কথা শুনে ইন্দ্রাদি দেবগণ থেকে শুরু করে ভগবান বিষ্ণু অত্যন্ত খুশি হলেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ বিবাহের সমস্ত উপকরণ পাঠিয়ে দিতে শুরু করলেন, সপ্ত মাতৃ দেবতা আনন্দের সঙ্গে শিবের বিবাহের জন্য উপযুক্ত বেশ করে দিলেন যদিও শিবের বিবাহের উপযুক্ত বেশভূষা করে দিলেন। যদিও শিবের বেশভূষার প্রয়োজন নেই তার বেশভূষা স্বতঃসিদ্ধ তথাপি তার প্রীতির জন্য তারা সকলে নতুন বেশে সাজিয়ে দিলেন মহাদেবকে। এইভাবে এক অপরূপ বেশ ধারণ করলেন দেবাদিদেব। নতুন বেশভূষায় পরম রমণীয় হয়ে উঠল তাঁর মুখ। তাঁর অঙ্গ কান্তি হয়ে উঠল আরও সমুজ্জ্বল। চন্দ্র স্বয়ং তার মস্তকে মুকুটের মতো শোভা পেতে শুরু করল। তার তৃতীয় নেত্র পরিণত হল এক সুন্দর তিলকে। তার কানের পুষ্পাভরণ হয়ে উঠল স্বর্ণাভরণ। অঙ্গের বিভূতি বা ভস্ম পরিণত হল চন্দনে। তার সর্পভূষণ হয়ে উঠল মনি মুক্তা খচিত রত্নালঙ্কারে। তার চর্ম হল উত্তম বসন। দেবাদিদেব শিবের দৈব প্রভাবে প্রাকৃত বস্তু সকল ধারন করল কৃত্রিম রূপ। এইভাবে শিবের দেহ সৌন্দর্য হয়ে উঠল বর্ণনাতীত।

শিব পুরাণে এই যে বিষয় উল্লেখ করলাম এখানে একটি বিষয় শিক্ষনীয় আছে তা হল হিমালয় রাজের কাছে যখন কন্যার বিবাহের অনুমতি চাওয়ার জন্য সপ্তর্ষিগণ গেলেন তখন তিনি যদিও জানেন যে এই বিবাহ দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে হচ্ছে তথাপি তিনি নিজের স্ত্রীর অনুমতি প্রার্থনা করলেন অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে সনাতন হিন্দু ধর্মে একজন স্ত্রীর মর্যাদা কতখানি। বিবাহ দেবতার সঙ্গেই হোক অথবা সাধারণ কোনও মানুষের সঙ্গে পিতা ও মাতা উভয়ের অনুমতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...