তখনও গ্রামের ঘুম ভাঙ্গেনি। তবে এক কিশোরী তখনও বেশ ব্যস্ত। অপূর্ব সুন্দর গ্রাম। হলদিয়ার এক গ্রাম। সূর্য ওঠার আগেই মেয়েটা উঠে পড়ে। ভোরের গ্রাম অপূর্ব এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে সে কিশোরী গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করার থেকেও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৌড়ে বেশি আগ্রহী। পলাশের অপূর্ব শোভা ছাতিমের গন্ধ তাকে ছুঁলেও তার অনুভব জুড়ে থাকে একটা লক্ষ্যে পৌঁছানো। সেই কারণেই ওই কিশোরী ঘুম থেকে উঠেই দৌড় শুরু করে। কোচ সুমিত বাগ তাঁকে সঙ্গ দেয়। আসল লড়াইটা লড়ে যায় কিশোরী।
এই দৌড় কোন গতানুগতিক রাস্তায় দৌড়ানো নয়, এই দৌড়ে মিশে থাকে যাবতীয় অন্ধকার দূর করার ব্রত। অন্ধকারকে ভেঙে আলো ছুঁয়ে ফেলার প্রবল ইচ্ছে মেয়েটাকে জোরে দৌড়তে সাহায্য করে। সেই কিশোরী কন্যার সঙ্গে বাঁধা থাকে কোচের হাত। মেয়েটা যে চোখে দেখে না। কিন্তু দৃষ্টিহীন মেয়েটা অনেকের থেকে বেশি স্বপ্ন দেখে। দৃষ্টিহীনদের দৌড়ের যাবতীয় বিধি প্র্যাক্টিস করে কোচের সঙ্গে হাত বেঁধে। আন্তর্জাতিক যে কোনও দৌড় প্রতিযোগিতায় এভাবে দৌড়ানোটাই নিয়ম।
সুমিত বাগকে অবলীলায় দ্রোণাচার্য বলা যেতে পারে। তিনি দুর্গা মিদ্যাকে শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে থেমে থাকেননি। তাঁর সঙ্গে দৌড়েছেন। কোচের কথায় দুর্গার সঙ্গে দৌড়াতে গেলে প্রয়োজন বিশেষ শক্তির। কারণ তাঁর সঙ্গে একই ছন্দে দৌড়ানো বেশ কঠিন। দুর্গা মিদ্যার উৎসাহ, আগ্রহ এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাব কোচকেও উৎসাহিত করত।
একশ শতাংশ দৃষ্টিহীন দুর্গা মিদ্যার দিন শুরু হত সকাল ৪টের সময়। সময়টা আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি দুর্গা। দৌড়তে বরাবর ভালোবাসতেন। আর ভালোবাসতেন সাঁতার কাটতে। এক নাগাড়ে ঘাম ঝরিয়ে এই তরুণী নিজের কোচকেও দৌড় করাতেন। এক সময় দৃষ্টিহীন বিভাগে দেশের দ্রুততম মহিলা ছিলেন এই দুর্গা। কোচ সুমিত বাগ ছিলেন তাঁর কো-রানার। হলদিয়ার রামপুর বিবেকানন্দ মিশন আশ্রমের দৃষ্টিহীনদের আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী দুর্গা মিদ্যা প্রথম থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী এবং প্রতিভাবান ছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি জাতীয়স্তরের প্রতিযোগী ছিলেন। ১০০ মিটার দৌড়ে দেশের সেরা দুর্গা। ব্লাইন্ড স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার আয়োজনে দিল্লি মুম্বাইয়ের মত জায়গায় দেশের নানা প্রান্তে তিনি বিভিন্ন ইভেন্টে জয়ী হয়েছেন। আঠারোটি জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় সোনার পদক পেয়েছেন। রূপো পেয়েছেন কয়েকটি প্রতিযোগিতায়।
এর মাঝেই ডাক এসেছিল স্পেনের মাদ্রিদ থেকে। আইবিএফ বা ইন্টারন্যাশনাল ব্লাইন্ড স্পোর্টস ফেডারেশন আয়োজিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্গা ভারত থেকে ১০০ মিটার বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন। কোচ কাম কো-রানার সুমিত বাগ ও দুর্গার আরেক কোচ কাম অ্যাটেনডেন্ট ছবি সামন্তও স্পেনের মাদ্রিদে গিয়েছিলেন। ১৯৯৮ এর ঘটনা এটি। দুর্গা সেবার দৌড়ে সপ্তম হয়েছিলেন।
১৯৯৯ সালে স্পেনের স্যারিতে অনুষ্ঠিত হয় অ্যাথলেটিকসের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ। এখানে সাধারণত কোন দৃষ্টিহীনদের সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। বিরল ক্ষেত্রে ডেমনস্ট্রেশন বিভাগে ভারত থেকে দুর্গা একা প্রতিনিধি হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কোচ-কাম কো রানার সুমিত বাগ। সারা বিশ্বে নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট আটজন দৃষ্টিহীন সুযোগ পেয়েছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। দুর্গা তাদের মধ্যে অন্যতম। সেখানে গিয়েও নিজের প্রতিভা প্রমাণ করে এসেছেন দুর্গা।
দৃষ্টি না থাকলেও নিজের জীবনকে আলো হিসেবেই দেখেছেন দুর্গা। ১০০ মিটার দৌড়ের জন্য ১২০ মিটার দৌড়ানো অনুশীলন করতেন তিনি। কোচ অবাক হয়ে যেতেন। ১৬ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়াতে পারতেন দুর্গা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দুর্গার সাফল্যের কথা প্রকাশিত হয়েছে। দুর্গা এখন পুরসভার চুক্তিভিত্তিক কর্মী।
বয়সের ভার, ক্ষমতার অভাবে দুর্গা আজ হয়তো সেভাবে খেলাধুলাকে আর সময় দিতে পারেন না, কিন্তু স্মৃতি বলতে কাক ভোরে ওঠে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে দৌড়ানোর কথাই বারবার বলেন, সাফল্যের চূড়াও লড়াইয়ের কথা ভোলাতে পারে না দুর্গার মত এমন লড়াকু, মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের।