অষ্টমগর্ভ ও অষ্টমী তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হল কেন?

'জন্মাষ্টমী' বললেই, মনে প্রশ্ন ওঠে--তথাকথিত অষ্টম গর্ভ ও অষ্টমী তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হল কেন? দৈববাণীর জন্য? তাহলে, দৈববাণীই বা হল কেন? সে কি অত্যাচারী কংসকে হত্যার জন্য? আচ্ছা, কংসই বা অত্যাচারী হলেন কেন?--আধ্যাত্মিকতা দিয়ে বিচার করলে চিরাচরিত ভক্তি-ভাবালুতা ছাড়া উত্তরে নতুন কিছুই পাওয়া যাবে না। আসুন, আধ্যাত্মিকতার খোলস ছেড়ে তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার পথ বেয়ে এসব প্রশ্নমালার উত্তর খুঁজি...

যে পৌরাণিককালে কৃষ্ণকথার অবতারণা, সে-সময় ভারতবর্ষের বুকে ভোজ-বৃষণী-অন্ধক প্রভৃতি নানান প্রতাপশালী বংশের রাজত্ব। তারা একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তলে তলে একে-অপরের রাজ্য ছলে-বলে-কৌশলে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় তারা সবসময়ই ষড়যন্ত্রমুখর। কৌশলে কাজ উদ্ধার হলে সাপ মরে অথচ লাঠিও ভাঙে না। তাই বুদ্ধিমানেরা এই কৌশলপন্থারই পক্ষপাতী।  বৃষণী বংশের বসুদেব বুদ্ধিমান রাজা। তিনি কৌশলে রাজ্য অধিকার করার ইচ্ছেয় প্রতিদ্বন্দ্বী বংশের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। তাই এক স্ত্রী রোহিনী বর্তমান থাকতেও দ্বিতীয়পক্ষ হিসেবে গ্রহণ করলেন ভোজ বংশের কন্যা দেবকীকে। 

দেবকী ভোজ বংশের রাজা উগ্রসেনের ভাইঝি। উগ্রসেন মথুরা-গোকুলসহ বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ গো-বলয়ের রাজা। ফলে, সবারই এই রাজ্যের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি। কিন্তু, ক্ষমতায় বীর উগ্রসেন বা তাঁর পুত্র কংসের সঙ্গে পেরে ওঠার মতো বুকের পাটা সেইসময় কারও ছিল না। এখানেই কৌশলে সবাইকে টেক্কা দিলেন বসুদেব। তিনি বলপ্রয়োগের ধার দিয়েই গেলেন না, স্বভাবে সরল উগ্রসেনের কাছে দূত পাঠিয়ে, তাঁকে ভজিয়ে কৌশলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভোজ বংশের অন্দরে ঢুকে পড়লেন। তাঁর পরের খেলা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, পরম ঘোড়েল এবং ক্রুর কংস যথারীতি বসুদেবের মনের কথাটি পড়ে ফেললেন। তিনি বোনের বিয়ের আনন্দ-অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন, তাকে নিজে রথ চালিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিতে গেলেন। ভাব দেখালেন, যেন তিনি এক আদর্শ দাদা! আর এসবের মাঝেই কংস মনে মনে ভেঁজে চললেন বসুদেবকে মাত দেওয়ার নিখুঁত পরিকল্পনা। নববধূ ও বরকে নিয়ে শোভাযাত্রা যখন নগর ছাড়িয়ে নির্জন প্রান্তরে উপস্থিত হল, তিনি সকলকে ছাড়িয়ে রথ নিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং হঠাৎ করেই রথ থামিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি এক নিষ্ঠুর দৈববাণী শুনেছেন--দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান তাঁকে নাকি হত্যা করবেন। ব্যস, তিনি দেবকীকে হত্যা করতে গেলেন, যাঁকে বিয়ে করে এ-বংশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন বসুদেব, তাঁকেই শেষ করে দেবেন।  দৈববাণী-গুজবের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর, বোনকে হত্যার একটা অজুহাত চাই এবং এমন একটা অজুহাত যেখানে পিতাকে এবং প্রজাদের ভুল বুঝিয়ে শান্ত রাখা যায়। কিন্তু, যতই হোক বোন তো, দেবকীর আকুতির কাছে তিনি কিছুটা নত হলেন। তাঁকে প্রাণে মারলেন না। বন্দি করলেন বসুদেবসহ। এবার স্পষ্ট হল কংসের দ্বিতীয় কৌশল। হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে, বন্দি করে রাখবেন। অষ্টমগর্ভের সন্তান তাঁকে হত্যা করবে--এমনটা রটালে বসুদেব-দেবকীকে দীর্ঘদিন বন্দী রাখা যাবে। তার মধ্যেই অবাধ্য হলে পিতাকে বন্দি করেও কংস স্বয়ং সিংহাসন অধিকার করে মথুরার রাজা হয়ে যাবেন। তাই 'অষ্টমগর্ভ'।

দেবকীর গর্ভের সন্তান সত্যিই যদি কংসের কাল হত, তাহলে দেবকী ও বসুদেবকে একই কুঠুরিতে বন্দি না-করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে রাখলেই হত। কংসের নিশ্চয়ই কুঠুরির অভাব ছিল না! আর অষ্টমগর্ভই যদি শুধু কংসের দৈববাণী নির্ধারিত নিয়তি হত, তাহলে তিনি অন্য সন্তানদের হত্যা করলেন কেন? আসলে, নিজের রাজ্য ও সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করতে বৃষণী বংশকে ঝাড় সমেত শেষ করে দেওয়ার এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এটা একটা নিষ্ঠুর পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। রোহিনী যদি নন্দের ঘরে এসে না লুকোতেন, তাহলে তাঁকেও হয়তো হত্যা করতেন কংস।

যাইহোক, অষ্টমগর্ভের সন্তান হয়ে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিলেন। মায়ায় বলুন, রক্ষীদের গোপন সাহায্যে বলুন, বসুদেব তাঁকে গোকুলে রেখে এলেন। আর কংসের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে এলেন নন্দের সদ্যোজাত কন্যাকে। তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? কংস যদি জেনেই থাকেন যে, অষ্টমগর্ভে পুত্রসন্তানের জন্ম হবে, তাহলে কন্যাসন্তানটিকে তিনি দেবকীর সন্তান বলে বিশ্বাস করলেন কী করে? অষ্টমগর্ভের কন্যাসন্তান তো কংসের শত্রু নয়, বংশের প্রদীপও নয়--তাহলে কংস তাকে হত্যা করতে গেলেন কেন? এখানেই স্পষ্ট হয় প্রতিহিংসাতত্ত্ব। এখানে আর একটা নির্মম প্রশ্নও উঠে আসে, বসুদেব নিজের পুত্রের প্রাণ বাঁচাতে নন্দের কন্যাকে শত্রুর হাতে কোন মানবিক ভাবনা থেকে তুলে দিলেন? কন্যার প্রাণের কোন মূল্য নেই? তাকে সহজেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায়? 

যাইহোক, বসুদেব পুত্রকে রক্ষা করলেন। কারাগারের প্রহরীদের বাধা পেরিয়ে ঝড়-বৃষ্টি-বিদ্যু উপেক্ষা করে যমুনা পেরিয়ে এত কাণ্ড করে তিনি বন্ধুর বাড়িতে পুত্রকে সুরক্ষিত রেখে এলেন। কিন্তু, কন্যারূপী মহামায়া-দুর্গা কংসকে বলে দিলেন, 'তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!' ঠিকানাই যদি বলে দিলেন, তাহলে এত কাণ্ড করা হল কীসের জন্য! এতে কী কৃষ্ণের সুরক্ষায় বিঘ্ন ঘটল না?

কৃষ্ণ জন্ম নিলেন রোহিনী নক্ষত্রে অষ্টমী তিথিতে। কেন? উত্তরের উৎস আছে ঋক্ বেদে। সেখানে রোহিনী নক্ষত্রকে বন্দনা করে বলা হয়েছে--রোহিনী সৃষ্টিতে নতুন প্রানের সঞ্চার করে, জীবন কর্ষণ করে তাতে চেতনার সঞ্চার করে। সেখানে 'কর্ষণ' বোঝাতে 'কৃষ্ণ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বেদের যুগে কৃষ্ণকথার আবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু, পুরাণের যুগে যখন লোকচর্চা থেকে কৃষ্ণকাহিনি গড়ে উঠল, তখন বেদের রোহিনীবন্দনার 'কৃষ্ণ' শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল অবতার শ্রীকৃষ্ণকে। আর তখনই তাঁর জন্মক্ষণের সঙ্গে জুড়ে গেল রোহিনী নক্ষত্র। অষ্টমী তিথি। স্মৃতিকারেরা তাতে মান্যতার মোহর লাগলেন। কালক্রমে কৃষ্ণ আমাদের কাছে মহাভারতের হাত ধরে পরম কূটনীতিক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। সপ্তম শতাব্দীতে এসে মহারাষ্ট্রের কবি হাল-এর লেখা 'গাহাসপ্তসতী' কাব্যের প্রভাবে রাধা জুড়ে গেলেন কৃষ্ণের সঙ্গে। দু'জনে হয়ে উঠলেন শাশ্বত প্রেমের প্রতীক। আর ভাগবত বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় ভক্তজন পেলেন বাৎসল্য রসের স্বাদ। তাঁর মধ্যে একদিকে দেখতে পেলেন নিজের সন্তানের ছায়া, অন্যদিকে এক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী অবতার ও ভগবানকে। ফলে, তাঁর জন্মদিন ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ধর্মীয় মহোৎসব। পার্বণ। জন্মাষ্টমী পর্ব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...