গৌড় থেকে অযোধ্যা অনেক অনেক দূর। কৃত্তিবাসী 'রামায়ণ' বাঙালির ঘরে ঘরে একসময় পূজিত হলেও, কৃত্তিবাস অযোধ্যাকে বাংলার পদ্মশোভিত পুকুরের পাশে স্থাপন করলেও; বাঙালির চেতনায় রামচন্দ্র কখনই বাঙালি হতে পারেননি, অচিন দেশের অননুকরণীয় অবতার হয়েই থেকে গেছেন। বাঙালি তাঁর অকাল বোধন থেকে প্রাণিত হয়ে শরতের দুর্গা পুজোকে নিজস্ব সংস্কৃতির অঙ্গ করে নিল, কিন্তু, রাবণবধের বিজয়-উৎসবকে বিজয়া দশমীর উৎসব বলে গ্রহণ করল না। কেন? আসুন, উত্তর খুঁজি :
বাংলার শাক্তধর্ম ও শক্তিসাধনার প্রাচীন পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের ইতিহাসে। তখন থেকে ষোল-সতের শতক অব্দি শক্তিসাধনা ছিল নেহাতই বামাচারী তান্ত্রিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের হাত ছাড়িয়ে দেবী দুর্গার আরাধনা ও মাতৃমুখী সাধনার প্রসার ঘটল নদিয়াবলয়ে, বৈষ্ণব ধর্মের বিরুদ্ধে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের মতো মাতৃসাধক দেবীকে নিয়ে গান বাঁধলেন। তৈরি হল সে গানের দুই মূল পর্ব--আগমনী ও বিজয়া। এছাড়াও গড়ে উঠল নানান উপপর্ব ও অনুপর্ব। দেবী হয়ে উঠলেন বাংলার মেয়ে, ঘরের মেয়ে। তাঁর আগমনে তাই আনন্দের সুর ধ্বনিত হল আর বিজয়ায় শোনা গেল বিদায়ের কান্না। এই যে দেবীকে নিজের মেয়ে করে নেওয়া, তা একেবারেই বাংলার লৌকিক বোধ থেকে হয়েছে, শাস্ত্রের এখানে কোন ভূমিকা নেই। শাস্ত্র কখনোই দেবীকে মানবী হতে দেয়না, তাঁকে কখনই এভাবে মেয়ের মতো আপন করতে দেয় না। এই যে শাস্ত্র ও লোকাচারের মেলবন্ধন; এটা বাংলার শারদ উৎসবের বিরাট একটা বৈশিষ্ট্য। শাস্ত্র থেকে উদ্ভূত হয়ে লৌকিকে তার বিস্তার।
বাংলায় 'বিজয়া' শব্দটির, ভাবের দিক থেকে মানে হয়ে উঠল যেন, 'মেয়েকে বিদায়'। আসলে, তার তলায় চাপা পড়ে গেল পুরাণ কথিত বোধনের দশম দিনে ঘোরতর যুদ্ধের শেষে মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর 'মহিষাসুরমর্দিনী' হয়ে ওঠার গাথা। চাপা পড়ে গেল, সেই 'বিজয় উৎসব' অর্থাৎ 'বিজয় দিবস' উদযাপন থেকে দিনটির 'বিজয়া'-নাম হয়ে ওঠার কথা। চাপা পড়ে গেল, 'রামায়ণ' কথিত অকাল বোধনের পর এই দিনে দুষ্ট দশানন রাবণকে বধ করে বিজয় উৎসব উদযাপনের স্মৃতি অর্থাৎ দশেরার কথা। বাংলার বুকে এসে সব হানাহানির ইতিহাস চাপা পড়ে গেল, জেগে রইল শুধু জনকজননি ও সন্তানের শাশ্বত সম্পর্কের প্রদীপ্ত এক শিখা।
তাই বিজয়ায়, মেয়ের বিদায় বেলায় এক বিশেষ আচার অনুষ্ঠিত হয়, মায়েদের সিঁদুর খেলা। এই খেলা যতটুকু শোনা যায়, আড়াই-তিনশো বছরের বেশি পুরনো নয়। ঐতিহ্যটির শুরু বাংলার বুকেই কোন এক জমিদারবাড়ির অন্দরমহল থেকে। মেয়ের সৌভাগ্য কামনায়, আজীবন এয়োতি হয়ে থাকার কামনায় মায়েদের এ যেন এক জাদুচর্চা। কিন্তু, এ কেমন জাদু? আসলে মায়েদের বিশ্বাস, সিঁদুরের এই ছোঁয়াছুঁয়ির খেলায় মেয়ের সিঁথির সিঁদুরের সঙ্গে হাজার হাজার মায়ের সিঁথির সিঁদুর মিশছে, ফলে, সিঁদুরের সঙ্গে তাঁদের এয়োতি-সৌভাগ্যও আশীর্বাদের মতো পৌঁছে যাচ্ছে মেয়ের কাছে, তাতেই মেয়ে অর্জন করছে আজীবন এয়োতি থাকার সৌভাগ্য। আবার অনেকে মনে করেন, মেয়ের সিঁদুর যেহেতু সবার সিঁদুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, ফলে, সিঁথির সিঁদুর অর্থাৎ সিঁদুরের প্রতীকে স্বামীর প্রাণ হরণ করতে এলে যমদূতও বিমূঢ় হয়ে সিঁদুর চিনতে না-পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে, ফলে, সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হবে।
তাছাড়া বিজয়া দশমীর দিন যে গুরুজনদের প্রণাম করার ঐতিহ্য, আশীর্বাদ নেওয়ার ঐতিহ্য এবং আশীর্বাদপ্রার্থীকে মিষ্টিমুখ করানোর ঐতিহ্য; তা আসলে বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়কার আচার থেকেই এসেছে। যাত্রাপথের আশীর্বাদ, বিদায়ের আগে কিছু খাইয়ে পাঠানোর আবেগ--যা আমাদের কন্যাবিদায়ের আচারের অঙ্গ, তাই-ই মিশে আছে বিজয়ার মধ্যে। ফলত, বাংলায় বিজয়ার যে বিস্তার, তা নিছক দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের ইঙ্গিতবাহী 'দশেরা'র মধ্যে নেই। দশেরায় বীরত্ব আছে, কিন্তু, বাংলার বিজয়ায় ব্যাপ্ত আছে বাঙালির নিজস্ব চরিত্র ও আত্মা। 'বাঙালি'- নামক একটি বিশিষ্ট জাতির আত্মা। ভাবলোকমণ্ডিত সে আত্মায় রূঢ় বীরত্ব ঠাঁই পাবে কী করে! আর এই না-পাওয়াতেই অবশ্য বঙ্গের আবহমান সংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্যের মঙ্গল। সেটি সংস্কৃতিগতভাবে প্রাদেশিক হতে পারে, কিন্তু কখনই সংকীর্ণ নয়।