রবি ঠাকুরের শ্রাবণের গানে তিনি আকুল করে তোলেন শ্রোতাকে। গান শুনতে শুনতে মেঘ নেমে আসে মাথার ওপর। মেঘ মন্দ্রিত কণ্ঠস্বর। গানের শব্দ ঝরে পড়ে । বেদনার সঙ্গে তার বাস। মুহূর্তে থেমে যায় দিনের কাজ। ভেঙে ভেঙে পড়ে নীরব যন্ত্রণার শিশির। দ্বিধাহীন আত্ম নিবেদন।
জর্জ বিশ্বাস একলা পথে গেয়ে যান,
অতি দূরে দূরে ভ্রমিছি আমি হে ‘প্রভু প্রভু’ ব'লে ডাকি কাতরে।।
সাড়া কি দিবে না। দীনে কি চাবে না। রাখিবে ফেলিয়ে অকূল আঁধারে?
কে তাঁর প্রভু? কার জন্য তাঁর সুরে সুরে নিজেকে এমন নিংড়ে দেওয়া ? যেন মধ্য রাতের বিরহী কোকিলের প্রাণ ঢালা হাহাকার!
উত্তর কোথাও লেখা নেই। তবু যেন মিলে যায় । তাঁর সমস্ত রুদ্ধ সুরের অভিমুখ যেন একই দিকে বইছে। তিনি রবিঠাকুর। জর্জ বিশ্বাসের রবি ঠাকুর।
সমস্ত যন্ত্রণা, বেদনা, দিন যাপনের গ্লানি যেন সেখানেই নিবেদন তাঁর।
অথচ গায়ক হবেন কখনও ভাবেননি, তবু রবি ঠাকুর তাঁর আরাধ্য দেবতা। তাঁর গান শুনে চমকে যান ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী। রবি ঠাকুরের গানে তিনিই তাঁর প্রথম গুরু।
ছোট বেলায় দাদু কালীমোহন বিশ্বাস ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বাড়িতে সমাজের গান চলত। সংসারের হাজার কাজের ফাঁকে ফাঁকে মা অবলা দেবী গাইতেন ব্রহ্ম সঙ্গীত। স্কুলের দিনগুলোতে মায়ের সঙ্গে ময়মনসিংহ ব্রাহ্ম সমাজের মাঘ উৎসবে গান গাইতেন। তখনও অবশ্য জানতেন না গানের রচয়িতা কারা। তবে সেই গানে মিশে থাকতেন রবিঠাকুর। তাঁর সঙ্গে চেনা জানার শুরুয়াতটা এভাবেই।
বাড়ির গানের পরিবেশে সুরের মুকুল ধরেছিল দেবেন্দ্রমোহনের বিশ্বাসের ছেলের মধ্যেও। মহেন্দ্র রায়ের কাছে দেশপ্রেমের গান শিখতে যেতেন। কিশোর গঞ্জের স্বদেশী সভায় গেয়ে বেড়াতেন সেই গান।
কিশোর গঞ্জে কলেজ তে্মন ছিল না। তাই স্কুলের পাঠ শেষ করে আসতে হল কলকাতায়। সন ১৯২৮। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে কলকাতার ব্রাহ্ম উপাসনালয়ে যাতায়াত শুরু হল।
সেই সূত্রেই একবার সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথকে দেখার। ওই বছরেই ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার একশো বছর উপলক্ষ্যে। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে ভাদ্রোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।
৬ ভাদ্রের সকাল। বিশেষ উপাসনায় আচার্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।
তিনি তখন বেশ অসুস্থ। অশক্ত শরীর। তবু সাড়া দিয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের ডাকে।
কলেজ পড়ুয়া দেবব্রত দেখলেন কবিকে ঘিরে ধরা ভিড়ের মধ্যে থেকে দুজন তাঁকে ধরে ধরে বসিয়ে দিলেন আচার্যের বেদীতে।
ক্ষীন কণ্ঠে, দুর্বল দেহে বিশেষ উপাসনার দায়িত্ব সামলে ছিলেন। শেষ একটি ব্রহ্মসঙ্গীতও গেয়েছিলেন স্বকণ্ঠে।
সেই সময় ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে কবির সম্পর্ক খুব মধুর নয়। তার ঠিক এক-দুবছর আগেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রবীণ সদস্যরা তীব্র আক্রমণ করেছিলেন কবির। ভদ্রঘরের মেয়েদের জনসমক্ষে নৃত্য প্রদর্শন তাঁরা মানতে পারেননি। পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল সমালোচনা।
পরিনত বয়সের দেবব্রত এই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে লিখছেন, ‘৬ ভাদ্র মন্দিরে গিয়ে খবর পেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ খুব অসুস্থ। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়তো অভিমানই আসল কারণ। কিন্তু যখন দেখলাম তাঁর অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি মন্দিরে উপস্থিত হলেন সত্যি বিস্মিত হয়েছিলাম।’
সেদিনের কলেজ পড়ুয়া ছাত্রটি জীবনের পাকে পাকে ঘুরপাক খেতে গিয়ে পরে অনুভব করেন আসলে নিজের লেখা শব্দকেই প্রতিফলিত করেছিলেন কবি সেদিন নিজের জীবনে, ‘সব বিদ্বেষ যেন দূর হয়ে যায় যেন তব মঙ্গলমন্ত্রে’। গ্লানিহীন মালিন্যহীন ক্ষমাসুন্দর তাঁর অনুভূতি। নিজের মধ্যে নিজেই অশেষের লীলা।