শিক্ষাব্রতী সাবিত্রী

সময়টা উনিশ শতক। জাত-পাত বর্ণ-ভেদের মত কুপ্রথা সমাজকে মাকড়সার জালের মত বেঁধে রেখেছিল তখন। নূন্যতম শিক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল বিভেদ। সমাজের শ্রেণীবিভেদের গেরোয় আটকে থাকা নিম্নবর্গের মানুষ ছিল না পড়াশোনার অধিকার। মেয়েদের শিক্ষার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবুও কিছু ব্যতিক্রম থাকে। হয়তো সমাজকে পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যেই তাঁদের এই পৃথিবীতে আসা। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার নয়গাঁও গ্রামের লক্ষ্মী এবং খান্দোজি নেভেশে প্যাটেলের এক কন্যা ছিল। তাঁরা মালি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

সেই মেয়ের ছোট থেকেই পড়াশোনা করার ভারি শখ। ''মালির মেয়ে আবার পড়াশোনা করবে কি?''। সমাজের ব্রাহ্মণরা চোখ রাঙাচ্ছিল। অগত্যা যা গতি হয় অন্য মেয়েদের, তাই হল সেই ছোট্ট মেয়ের। মাত্র নয় বছর বয়সে বিয়ে হলো। তবে ওই যে কথায় আছে, ইচ্ছাশক্তিই অধ্যাবসায়ের মূল। নিজের স্ত্রীর পড়াশোনার ইচ্ছের সম্মান দিলেন সেই বালিকার তেরো বছরের স্বামী। নিজের স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ ফুলেকে এভাবেই শিক্ষিত করেছিলেন তাঁর স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে। বিয়ের সময় প্রাথমিক শিক্ষাও ছিল না সাবিত্রীবাঈ ফুলের। বাড়িতেই নিজের স্ত্রীকে পড়াতেন জ্যোতিরাও। একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন জ্যোতিরাও, নিজে পড়াশোনা করার পাশাপাশি সাবিত্রীর মধ্যে অন্যকে শিক্ষিত করার স্পৃহা ছিল প্রবল।

একদিন স্ত্রী এসে স্বামীর কাছে জানালেন তাঁর ইচ্ছের কথা ''আমি যদি বাকিদেরও পড়াই, আমরা তাহলে সকলে একসঙ্গে শিখতে পারি!'' এককথায় মেনে নিয়েছিলেন স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে। নিজের পড়াশোনা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের শেষে সাবিত্রীবাই আশেপাশের অল্পবয়সী মহিলাদের পড়ানো শুরু করলেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এসে সাবিত্রী বুঝতে পারলেন একমাত্র প্রকৃত শিক্ষায় মুছে দিতে পারে অন্তরের অন্ধকার। ‌ তিনি নিজের সাধনায় হয়ে উঠেছিলেন সকলের শিক্ষিকা।

প্রতিভাবান এই নারী কবিতা লিখতেন নিয়মিত। তাঁর কবিতার বিষয় থাকত নারীশিক্ষা এবং তার অপরিহার্যতা। দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল সাবিত্রীবাঈ ফুলের। মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, তবুও নানা অন্ধকার এই সমাজকে ছেড়ে যাচ্ছে না। বারবার এমনটা মনে হতো সাবিত্রীবাঈ ফুলের। অন্যের উপর নির্ভরশীলতা নারী প্রগতির অন্যতম বাধা বলে মনে করতেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে এবং নারীদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের চিন্তাভাবনার ভেতরেও নারী-শিক্ষার বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে। অবশ্যই তা হবে জাতপাতের অন্ধকারবিহীন শিক্ষা।

ধর্ষিতা ও অসহায় মহিলাদের জন্য একটি সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে। সেই সময় সমাজ থেকে ব্রাত্য ছিলেন বিধবারা। সব মেয়েদেরই আপন করে নিতেন সাবিত্রীবাঈ সমান ভালবাসায়। তবে সাবিত্রীবাঈ বুঝেছিলেন, শুধু আশ্রয় দেওয়াই সব নয়, মেয়েদের আর্থিক সচ্ছলতাই তাঁদের প্রকৃত সম্মান অর্জন করতে সাহায্য করতে পারে।

১৮৪৮ সালে সাবিত্রীবাঈ ফুলে এবং তাঁর স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে প্রথমবার মহারাষ্ট্রের পুনেতে মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। সাবিত্রীবাই ছিলেন দেশের প্রথম শিক্ষিকা। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ তাঁর জীবিতকালে মোট আঠারোটি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুলগুলিতে ছিলনা কোন বর্ণ বা জাতপাতের বিভেদ।

মেয়েদের শিক্ষাদান তো চলছে, কম সংখ্যায় হলেও সাবিত্রীবাঈ-এর স্কুলে আসছেন মেয়েরা, তবুও সমাজ থেকে ঘুচে যাচ্ছে না মেয়েদের দুরবস্থা। তার কারণ মেয়েরা নিজেরাই যে সম্পূর্ণভাবে সচেতন নয় নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে। সাবিত্রীবাই বুঝেছিলেন গ্রামীণ ও শহরের মহিলাদের সমস্যাগুলো ভিন্ন হলেও কোথাও তারা একই গোত্রের। অর্থাৎ সমস্যার মূল একই। সকলকে একত্রে নিয়ে আসার জন্য তিনি গড়ে তোলেন মহিলার সেবা মন্ডল।

নিজের বাড়ির কুয়োয় জল নিতে আসার অধিকার দিয়েছিলেন সব জাত-ধর্মের মানুষদের। সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন সকল ধরনের কুপ্রথার বিরুদ্ধে। এক কুসংস্কারমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন সাবিত্রীবাঈ। তার জন্যে কম হেনস্থা সহ্য করতে হয়নি। এমনও হয়েছে যে, তিনি স্কুলে পড়াতে আসছেন, তার গায়ে কাদা ছোড়া হয়েছে। স্কুল পরিচালনা করেছেন অনেক বাধা সামলে।

বেপরোয়া, সাহসী ছিলেন সাবিত্রীবাঈ। তাঁর নিজের কোন সন্তান ছিল না। তাঁর দত্তক পুত্র যশোবন্ত ফুলেকে ডাক্তারি পড়ানোর পাশাপাশি সেবায় নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন।

তখন প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষেরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না ঠিকমত। সাবিত্রীবাঈ ফুলে তাঁর ছেলে যশবন্তের সঙ্গে মিলে গড়ে তুললেন প্লেগ চিকিৎসা কেন্দ্র। এমনকি প্লেগ রোগীদের আশ্রয় দিতেন বাড়িতে। আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হন প্লেগে। ১৮৯৭ সালের ১০ই মার্চ মৃত্যু হয় তাঁর। সমাজ তার ছন্দে এগিয়েছে, তবুও এই সব মানুষদের কথা, কাজ আড়ালে থেকেছে, কিন্তু তাঁদের সাধনা আলো যুগিয়েছে সমাজকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...