শতবর্ষে সেতারের জাদুকর পন্ডিত রবিশঙ্কর

পাহাড় ঝর্নার পথ আটকালো। বলে, ' কোথায় '? ঝর্না বলে ওঠে, ' একজনের সেতারে রাগ হয়ে বইতে চলেছি '। এক আদরের ছায়ায় বেড়ে ওঠা গ্রাম। চলে যাওয়ার পালা এক পুরোনো বট গাছের। পুকুরের ঘাটে কলসি পড়ে যায়। নিঃশব্দ পটভূমিকায় শুধু শোনা যাবে কলসির পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। সেতারে স্মরণীয় করে রাখলেন সেই সৃষ্টি। ১৯৭১ সালের ১ অগস্ট। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। মায়ের আঁচল তখন অনাহার ঢাকার যুদ্ধে কাতরাচ্ছে।

আয়োজক তিনি আর এক বন্ধু সঙ্গীত শিল্পী। কিংবদন্তী ইনিও। উপার্জিত অর্থ পৌঁছবে বাংলাদেশ ত্রানে।উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্ম হলেও আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশের নড়াইল। জীবিকার খোঁজে বাবা শ্যামশংকর চৌধুরি বেনারসে চলে যান, ঝালওয়ারের মহারাজার কর্মী রূপে। পন্ডিত রবিশঙ্কর। যিনি সেতারের তানে মিলিয়েছিলেন প্রাচ্য - পাশ্চাত্য সঙ্গীত সুধা।

বয়স তখন দশ। বড়দা উদয় শংকরের নাচের দলের সঙ্গে প্যারিসে যাত্রা। তিন বছর পর তালিম শুরু।ধীরে ধীরে মিশে যান। সেতার তখন মনের আলমারিতে বন্ধ। একবার ইউরোপে পা।দলে তখন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। জহুরী চিনে নিয়েছিলেন তাঁর জহর। তাঁর সিদ্ধান্তে হাতে সেতার উঠলো। মেঘ জমে গিয়েছে ততদিনে। এবার বৃষ্টি হওয়ার পালা। শর্ত, শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত একনিষ্ঠ থাকতে হবে। মঞ্চ আর করতালি ভুলে চার দেওয়ালে সেতার আবদ্ধ হলেন।সাধনা চলেছে খোলা আকাশের নীচেও                           ।

শিল্পী পূর্ণ হলেন গুরু কন্যার আগমনে। বয়স তেরোর এক কিশোরী। উজ্জ্বল ও দারুণ ভাবে নজরকাড়া অন্নপূর্ণা দেবী ভর করলেন প্রেমের সেতারে। প্রণয় ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে বিবাহ তটে ভেসে উঠলেন। সেখানেই চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে নিরন্তর বুঁদ হয়েছেন অনুশীলন ও সাধনায়। এভাবেই রচনা হয়েছে জীবন সঙ্গিনীর সঙ্গে ভালোবাসার উপাখ্যান। তবে সেই ভালোবাসা পরিচিত নয়। শিল্পীর জবানীতে তাঁদের সম্পর্কে প্রেম, রোম্যান্স, লুকোচুরি, ছিল না কিছুই।

কিন্তু যথার্থ পূর্ণতা পায়না এই অন্য ভালোবাসার সংসার। ভাবতে অবাক লাগলেও স্ত্রীর জনপ্রিয়তা দুইজনের ছেঁড়া তারে টান দেয়। প্রিয় সঙ্গীর মন রাখতে আর প্রাণের সেতার ছুঁলেননা অন্নপূর্ণা দেবী। এক আত্মাকে ধরে রাখতে অন্য আত্মার বিসর্জন। জন্মালো প্রথম সন্তান। আর দূত হতে পারলোনা সেও। নবজাতক দূরত্ব ডেকে আনলে, সেতার সম্রাট নিবন্ধ হলেন অন্য নারীর প্রতি। আত্মমর্যাদায় অনন্যা অন্নপূর্ণা দেবী সব রাগ, সুর ভুলে সন্তান নিয়ে ফিরে গেলেন আকর ভূমি। পরে আবার ফিরলেও আর জোড়া লাগেনা ছেঁড়া তার। রবিশঙ্কর এর মন তখন আটক নৃত্যশিল্পী সুকন্যা রাজন এর নূপুরের ছন্দে।

তাঁদের সন্তান অনুষ্কা আবার বাবার প্রাণের যন্ত্রে জীবনের ছন্দ ও আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। বাবা তাঁর সৃষ্টির উত্তরাধিকারীনী কে জন্ম দিতে পেরেছেন। ছিলেন বিরল চরিত্রের মালিক। অনায়াসে দিকপাল চিত্র পরিচালককে মাঝ রাতে ফোনে অনুকম্পা প্রকাশ করতে পারেন। তিনি কম্পোজার, তাঁর কম্পোজিশনে হাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। আবার সেতারে লাগতে পারে নতুন প্রেমের হাওয়া। স্যু জোনস, গায়িকা নোরা জোনসের জননী। এই পক্ষের কন্যাও জ্যাজ সঙ্গীতের নক্ষত্র।

সংসার - সন্তান - ভালোবাসার পারস্পরিক আঁতাত আপাতদৃষ্টিতে সুখকর না হলেও, সেই অভাব ঘুঁচেছে সঙ্গীতের দোহায়। সর্বজায়ার নৈঃসঙ্গে যেমন আবছা চোখে পড়ে তাঁর নিঃসঙ্গতা; তেমনই অপু আর অপর্ণার মধুর আঁখি বিনিময়ে প্রেম উজাড় হয়ে উপচে পড়ে শ্রোতা ও দর্শকদের মননে। ১৯২০ - র আজকের দিনে বারাণসী তে জন্ম এই ইন্দ্রজাল - এর। সঙ্গীত, অনুভূতি, সৃজনশীল বোধ ও মায়ার বিনি সুতোয় গাঁথা এক সঙ্গীতজ্ঞ ও বাদক। আজ শতবর্ষ পূর্ণ করা এই সুরোরথীর গোটা জীবনে প্রাপ্য সম্মানের হিসাব করা বোকামির নামান্তর মাত্র।তাঁকে স্মরণে এনেও কানে ধরা যেতে পারে একে একে সেসব সুর - ধ্বনি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...