বিবাহ-বাধায় রুক্মিণী দ্বাদশী ব্রত

বিদর্ভ নামে এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের রাজধানী ছিল কুন্ডিনপুরে। আর সেখানকার রাজার নামটি ছিল, ভীষ্মক। 

ভীষ্মকের হাতিশালে হাতি ছিল। ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। দেদার ভালমানুষী ছিল। পুত্রবতী রানি ছিল। উত্তরাধিকারী পাঁচ পুত্র ছিল। আর লক্ষ্মীর মতো একটি কন্যা ছিল। নাম তাঁর, রুক্মিণী।

রুক্মিণী--আহা, যেমন সুন্দর নাম, তেমন সুন্দর তাঁর রূপ! সেই রূপের কথা ভাটভিখারিদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল দেশে-দেশান্তরে।

বিদর্ভ থেকে দ্বারকা অনেক অনেক দূরের পথ। তবুও রুক্মিণীর সেই লক্ষ্মীশ্রী রূপের কথা ঠিক গিয়ে দ্বারকাপতি শ্রীকৃষ্ণের কানে উঠল। 'কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মনপ্রাণ'। নাম শুনে, রূপের কথা শুনেই সে-কালে হামেশা পূর্বরাগ হত। শ্রীকৃষ্ণেরও হল। এভাবেই প্রেমের প্রবেশদ্বারে পা রাখলেন কৃষ্ণ।

কৃষ্ণ তখন আর্যাবর্তের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষদের মধ্যে প্রধান। সুদর্শন, বলবান, নীতিবান, গুণবান; নারী যেমন পুরুষকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে, ঠিক তেমনটি। রূপে শিব, গুণে নারায়ণ।

তাঁর সেই রূপগুণের কথা রুক্মিণীর কানেও উঠল।সখীরা এ-সব ব্যাপারে খুব খবর রাখে, তাদেরই কাছ থেকে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে একটু একটু করে রসিয়ে রসিয়ে শুনলেন রুক্মিণী। তাতেই প্রগাঢ় পূর্বরাগে তিনি মনে মনে এমন মজলেন যে, দর্শনের জন্য একেবারে উতলা হয়ে উঠলেন।

ওদিকে রাজা ভীষ্মকও উতলা হলেন এই ভেবে যে, কন্যা যথেষ্ট যুবতী হয়েছেন, এবার বিবাহ তো দিতে হবে। পাঁচ পুত্রের পরে পাওয়া সবেধন কন্যাটিকে তিনি বড় আদরে মানুষ করেছেন। তাকে তো আর যেমন-তেমন রাজ্যের রাজপুত্রের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। পাত্র হিসেবে রাজপুত্রটিকে হতে হবে একেবারে সেরার সেরা, তবে না মানাবে!

রাজা কন্যার বিবাহ নিয়ে ভাবতে বসলেন বটে, কিন্তু তাঁর একবার মনেও হল না যে, কন্যাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি তো, তার মনে কেউ আছেন কি না। বরং তাঁর মনে হল, ছেলেরা যথেষ্ট বড় হয়েছেন। তাঁরাও বোনকে অসম্ভব ভালোবাসেন। তাই পাত্র বাছাইয়ের ব্যাপারে একটা শলা-পরামর্শের জন্য তাঁদের ডেকে পাঠানো দরকার।

RukminiDwadashi1

ডাকলেন। ছেলেরা এলেন। মন্ত্রনা শুরু হল।

রাজা বেজায় ভালোমানুষ হলেও ছেলেরা কিন্তু বেশ ঘোরপ্যাঁচের লোক। মেয়ের মনের কথা না-জেনেও রাজা কথায় কথায় একবার ভালো পাত্র হিসেবে কৃষ্ণের কথা তুলতেই জ্যেষ্ঠপুত্র রুক্মী তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দিলেন। 

আসলে, নিজের ক্ষমতা ও শক্তির অহংকারে রুক্মী এতটাই মত্ত যে, কৃষ্ণের সর্বগুণের সুনাম তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। তাই, চেদীরাজ শিশুপাল নানান সভায় যখন পদে পদে কৃষ্ণকে অপমান ও হেনস্থা করেন, সেটাতে তিনি খুব আনন্দ পান। আর সে-কারণেই শিশুপালকে তিনি বেশ পছন্দ করেন। তাছাড়া বীরযোদ্ধা হিসেবেও শিশুপালের যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। 

সুতরাং, কৃষ্ণকে বাতিল করে রুক্মী শিশুপালকেই পাত্র হিসেবে মনোনীত করলেন। অন্য ভাইয়েরা তাঁর প্রস্তাব নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন। রাজা খানিক গাঁইগুঁই করলেন বটে, কিন্তু রুক্মী তাতে পাত্তা দিলেন না।

পাত্র-নির্বাচনের খবরটি শুনে তো রুক্মিণীর মাথায় আকাশ ভাঙার জোগাড় হল। কৃষ্ণকে মনে মনে তিনি যে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন! তিনি এও জানেন যে, পিতা কখনই ভ্রাতার অবাধ্য হতে পারবেন না। এবং, এও জানলেন যে, ভ্রাতা কিছুতেই কৃষ্ণকে স্বীকার করে নেবেন না। তাহলে, এখন উপায়?

রাজধানীর প্রান্তিক প্রদেশে দেবী অবন্তিকার মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। রুক্মিণী প্রতিদিন গঙ্গায় অবগাহন করে মন্দিরে যান, দেবীকে দর্শন করেন, প্রণাম করে ফিরে আসেন। সেদিনও গেলেন, যে-করেই হোক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে এলেন দেবীর কাছে।

কিন্তু, তাঁর আকুতি কী দেবীকে স্পর্শ করল না? নইলে, এদিকে তড়িঘড়ি শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিবাহের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গেল কী করে! দেবী কি তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছেন? এ-পরীক্ষায় ধৈর্য ধরা অসম্ভব।

RukminiDwadashi2

মনে মনে দারুণ প্রমাদ গণলেন রুক্মিণী। ভাবলেন, শুধু দৈবের ভরসায় বসে থাকলে হবে না, নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। কৃষ্ণ তো জানেনই না যে, রুক্মিণী নামের একটি যুবতী তাঁকে ভালোবাসেন, তাঁকে স্বামী হিসেবে মনে মনে বরণ করে ফেলেছেন, তাঁকে না-পেলে যুবতীটির জীবনই ব্যর্থ হয়ে যাবে! তাঁকে সে-কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাতে হবে। কিন্তু, উপায়?

হৃদয় প্রবলভাবে কিছু চাইলে, কাউকে চাইলে উপায় ঠিক ইশারা করে। রুক্মিণী সেই ইশারা টের পেলেন।অমনি দেবী-দর্শনের অছিলায় মন্দিরে ছুটলেন। পুরোহিতকে জানালেন নিজের অবাধ্য হৃদয়ের কথা।

অনুনয় করলেন সে-হৃদয়ের কথা দ্বারকায় কৃষ্ণের কাছে পৌঁছে দিতে। বললেন যে, বিবাহের আগে বংশের প্রথা অনুযায়ী তিনি যখন দেবী-দর্শনে আসবেন, তখন কৃষ্ণ যেন তাঁকে হরণ করে দেবী অবন্তিকার মন্দিরেই বিবাহ করেন। নতুবা, এ-প্রাণ তিনি রাখবেন না!

পুরোহিত দূত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ সমীপে পৌঁছে দিলেন রুক্মিণীর হৃদয়বার্তা। সেই বার্তায় অপরপক্ষের প্রেম পেয়ে অপার উদ্বেল হলেন কৃষ্ণ। জানালেন, রুক্মিণীর যা ইচ্ছে, সেটা এখন তাঁরও ইচ্ছে। বিবাহের দিন সেই ইচ্ছের অন্যথা কিছু ঘটবে না।

পুরোহিত সেই বার্তা নিয়ে ফিরলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণের মন জেনে রুক্মিণী যেমন যার-পর-নাই উৎফুল্ল হলেন, তেমনি আশ্বাসবাণীতে প্রশান্তিও পেলেন। মন তখন স্বপ্ন-বুননের অবকাশ পেল।

RukminiDwadashi3

অবশেষে উপস্থিত হল বিবাহের দিন। সমস্ত রাজ্য আলোয়-বাহারে এমন সাজে সেজে উঠল যে, সমারোহ ও ঘনঘটার অন্ত রইল না। শুভক্ষণে অসংখ্য পরিচারিকা, বাদ্যকর, গীতিকণ্ঠ, নর্তকী ও সখী পরিবৃতা হয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কার বিভূষিতা হয়ে সুরম্য বস্ত্রে সজ্জিতা রুক্মিণী চললেন দেবী-দর্শনে। 

কিন্তু পথের মধ্যিখানে অতর্কিতে সেই রমণীয় আবহে ঢুকে পড়ল শ্রীকৃষ্ণের রথ। মুহূর্তেই রুক্মিণীকে নিজের রথে তুলে নিয়ে ঘোড়া ছোটালেন বাতাসের বেগে। চোখের পলকে পথের বাঁকে দু'জনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রুক্মিণীর সঙ্গীরা এক লহমা হতভম্ব হয়ে রইলেন, তারপরই 'হায় হায়' করতে করতে ভগ্নদূতের মতো রুক্মিণী-হরণের খবর দিতে রাজপুরীর ছুটতে লাগলেন!

কথামতো বিবাহের আয়োজন সমস্তই প্রস্তুত ছিল দেবী অবন্তিকার মন্দিরে। উপস্থিত ছিলেন পুরোহিত। মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণ সযতনে রুক্মিণীকে রথ থেকে নামালেন। নিয়ে এলেন গর্ভগৃহে।

তখন দেবী আবির্ভুতা হলেন। হাত ধরে দু'জনকে বসিয়ে দিলেন বিবাহ-মণ্ডপে। বললেন যে, তিনি রুক্মিণীর আর্তি শুনেছিলেন। তবে, চেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ-রুক্মিণীর প্রেম আপন গৌরবে পূর্ণতা পাক, হৃদয়বৃত্তের ঘেরাটোপে মিলন সম্পূর্ণ করুক।

দৈবকে সম্বল করেও ভরসা রাখুক আপন প্রণয়শক্তিতে। দেবীর সেই ইচ্ছে এখন পূর্ণ হল, তাই তো দুটি প্রেমজীবনও আজ এক হল। ত্রিলোকের কোন শক্তি এই জীবনে আর তাঁদের আলাদা করতে পারবে না।

RukminiDwadashi4

দেবীর কৃপা পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিণী নিজেদের ধন্যজ্ঞানে দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন। দেবী তাঁদের অশেষ আশীর্বাদ করে বিবাহ-আসনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। বিবাহ দিলেন। গর্ভধারিণীর মতো কন্যাকে বিদায় দিলেন।

ওদিকে কৃষ্ণ কর্তৃক রুক্মিণীহরণ হয়েছে শুনে ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হলেন রুক্মী। শ্রীকৃষ্ণ-রুক্মিণীর রথ তখন সবে দ্বারকার পথ ধরেছে। সেখানে ঝটিতে পৌঁছে রুক্মী পথ অবরোধ করে দাঁড়ালেন। তিনি পরাক্রমী অসিযোদ্ধা। তাই অকথা-কুকথার বন্যা বইয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে দারুণ আঘাত হানলেন কৃষ্ণের ওপর। শুরু হল ঘোরতর দ্বৈরথ।

রুক্মী ও শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই অসাধারণ বীর। তবে, শ্রীকৃষ্ণ অনন্য। তাই একসময় অসি ছিটকে পড়ল রুক্মীর হাত হতে এবং ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ উদ্যত হলেন তাকে বধ করতে। কিন্তু, রুক্মিণী তাঁকে ক্ষান্ত করলেন। বললেন যে, ভ্রাতৃরক্ত তিনি দেখতে চান না। অনুনয় করলেন, কৃষ্ণ যেন অনুগ্রহ করে তাঁর ভ্রাতাকে প্রাণদান করেন।

রুক্মিণীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ রুক্মীকে প্রাণে মারলেন না বটে, তবে অকথা-কুকথা বলার অপরাধে মাথাটি মুড়িয়ে দিলেন। তখন পরাজিত, অপমানিত ও লজ্জিত রুক্মীর মাথা নীচু করে পালানো ছাড়া আর কোন পথ রইল না।

শ্রীকৃষ্ণ-রুক্মিণীর পথে আর কোন বাধা এল না। তাঁরা নির্বিঘ্নে দ্বারকায় পৌঁছে দেবীর আশীর্বাদে সুখে সংসার করতে লাগলেন।

RukminiDwadashi5

ব্রতের গল্প এখানেই শেষ। এবার বলি ব্রত-সম্পর্কিত কিছু কথা। সেটুকুই এ-কথকতার উপসংহার :

শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে হরণ করে যে-দিন বিবাহ করেছিলেন, সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী তিথি। এই দিনটিতে যেহেতু দেবী অবন্তিকার আশীর্বাদ ও সহযোগিতায় রুক্মিণী কৃষ্ণকে পেয়েছিলেন এবং দেবী নিজে তাঁদের বিয়ে দিয়েছিলেন; তাই এই দিনটিতে ধীরে ধীরে দেবীর উপাসনা ও ব্রতপালনের বিধি তৈরি হল বিবাহেচ্ছুক ও বিবাহযোগ্যা যুবতীদের মধ্যে। ব্রতের নাম কিন্তু দেবীর নামে হল না, হল অনুগৃহীতা রুক্মিণীর নামে। নাম দেওয়া হল, 'রুক্মিণী দ্বাদশী ব্রত'। 

আসলে এমনটা করা হল রুক্মিণীর প্রেম, অপেক্ষা, উদ্যোগ ও উপাসনাকে নিরবধি স্মরণে রাখার জন্যই। রুক্মিণীর কথা এলে অনুগ্রহের কথা আসবে, অনুগ্রহের কথা এলে দেবীর কথাও আসবে। পর্যায়ক্রমটা এ-ভাবেই ভাবা হল।

যাই হোক, পঞ্জিকার কল্যাণে এ-বছর অবশ্য বৈশাখে নয়, রুক্মিণী দ্বাদশী ব্রতের নির্ঘন্ট নির্দিষ্ট হয়েছে এই জ্যৈষ্ঠ মাসে আজকের দিনে।

এ-বছর নিশ্চয়ই হবে না, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ফি-বছর এ-ব্রতের দিন ব্রতীনিদের বেশ সমারোহ দেখা যায় উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলার মুবারিকপুর খদরে গঙ্গাতীরে অবস্থিত দেবী অবন্তিকার মন্দিরে।

মন্দিরের গর্ভগৃহে দুটি দেবীমূর্তি পাশাপাশি অবস্থান করছেন। বাম দিকে মা জগদম্বা, ডান দিকে দেবী সতী। দুই দেবীকে একত্রে বলা হয়, 'দেবী অবন্তিকা'। দুই দেবীকে এই যে এক নামে এক করার প্রচেষ্টা, এ বেশ অভিনব।

লোকসাধারণের বিশ্বাস, রুক্মিণী দ্বাদশীর দিন (মতান্তরে, যে-কোন দিন) দেবীদর্শন করলেই বিবাহের সমস্ত বাধা কেটে যায়। কারণ, রুক্মিণী যে-মন্দিরে উপাসনা করতেন এই মন্দিরই নাকি সেই মন্দির; রুক্মিণীকে যে-দেবী অনুগ্রহ করেছিলেন, এই দেবী (আসলে, দেবীদ্বয়)-ই নাকি সেই দেবী। আসল সত্যটা, ইতিহাস জানে...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...