একাদশী ব্রত প্রথম শুরু হল কীভাবে?

'নারদীয় পুরাণ'-এর যুগে সোমবংশে বর্ষকীর্তি নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি কয়েক হাজার বছর ধরে বেশ আয়েশেই রাজত্ব করছিলেন। দীর্ঘদিন নিষ্কণ্টক রাজত্ব করলে যা হয়, রাজার মনে অহংকার আসে। আর এই অহংকারই তাঁকে বিপথে নিয়ে যায়, বেপরোয়া করে তোলে। বর্ষকীর্তির ক্ষেত্রও সেটাই ঘটল। তার ওপর বর্ষকীর্তি রাজা হিসেবে খুব যে একটা ভালো ছিলেন তাও নয়। তিনি ছিলেন স্বভাবে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। অত্যাচার করে আনন্দ পাওয়াটাই ছিল তাঁর পরম বিলাসিতা। আগে শুধু প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে আনন্দ পেতেন, আরও আনন্দ পেতে এবার শুরু করলেন মুনি-ঋষিদের ওপর অত্যাচার। তাঁর অত্যাচারে গ্রাম-নগর-আশ্রমের সবাই একেবারে যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন; তখন বর্ষকীর্তির খেয়াল চাপল যে, লোকালয়ে তো অনেক হল, এবার বনের পশুদের মেরেধরে তাদের ওপর অত্যাচার করে দেখতে হবে তামাশাটা কেমন জমে!

নগর পেরিয়ে কয়েক যোজন দূরে গভীর বন। সেই বনে আছে নানান জাতের হরিণ, খরগোশ আর নিরীহ সব প্রাণীদের বাসা। একদিন সৈন্যসামন্ত লোকলস্কর পাত্রমিত্র নিয়ে মহাআড়ম্বরে সেই বনে বর্ষকীর্তি চললেন শিকারে। বনে পা দিয়েই রাজার সঙ্গীরা সবাই মিলে শুরু করল তুমুল হৈ-হল্লা! হল্লা করেই তারা গোপন বাসা থেকে তাড়িয়ে বার করতে লাগল বনের প্রাণীদের। দিশাহারা হয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত বুকে ছুটতে থাকা সেইসব নিরীহ প্রাণীদের ওপর মহা আনন্দে শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন বর্ষকীর্তি। তীক্ষ্ণ শরের আঘাতে করুণ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়তে লাগল একে একে হরিণ-খরগোশের দল। সেই আর্তনাদে পৈশাচিক এক আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন বর্ষকীর্তি। তাঁকে দেখে তখন মনে হল যেন মূর্তিমান বীভৎস ও ঘৃণ্য এক জহ্লাদ! দেখতে দেখতে সেই পবিত্র বনভূমির সৌম্য মাটি রক্তে ভেসে গেল, জমে উঠল মৃত প্রাণীদের দেহ, বাতাস ভারি হয়ে উঠল রাজবাহিনীর পৈশাচিক উল্লাস আর মৃত্যমুখী প্রাণীদের করুণ আর্তনাদে! তবু রাজা থামলেন না। তাঁর চোখে তখন রক্তের নেশা। তিনি সেই নেশায় ছুটতে ছুটতে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, একা হয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন বনের গভীরে।

সেই গভীর বনে চোখের সামনে এখন আর একটাও প্রাণী নেই, তারা সকলেই যেন ইতিমধ্যে মরে গেছে! পাখিও নেই। তারা ভয়ে দলবেঁধে যেন অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে! সেই গহীন গভীর বনে একটাও ফলের গাছ নেই, তেষ্টা মেটানোর জন্য কোন জলাশয় নেই। পথ হারিয়ে সঙ্গী হারিয়ে বেঘোরে পড়ে রাজার চোখের রক্তনেশা এবার যেন হঠাৎ করে কেটে গেল। আর সেটা কাটতেই তিনি যেন টের পেলেন খিদেয় তাঁর পেট জ্বলে যাচ্ছে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে! এই অনুভূতি তীব্র হতেই পথ চলা তাঁর পক্ষে দায় হয়ে উঠল। মাথা ঘুরতে লাগল। তিনি ঘুরতে লাগলেন অরণ্যের গোলকধাঁধায়। বুঝলেন, এই গোলকধাঁধা থেকে বেরুতে না-পারলে মৃত্যু নিশ্চিত!

বর্ষকীর্তির মতো নিষ্ঠুর পাপীদের মৃত্যুকে খুব ভয়। তাই দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। দিন পেরিয়ে রাত হল, রাত পেরিয়ে দিন। অবসন্ন রাজা হাঁটার ক্ষমতাও হারালেন। তবুও তিনি থামলেন না। বুকে হেঁটে অতি কষ্টে মুমূর্ষু সরীসৃপের মতো এগোতে লাগলেন। চোখের সামনে দেখতে পেলেন তাঁর হাতে নিহত নিরীহ প্রাণীদের সাথে স্বয়ং মৃত্যু এসে তাঁকে যেন অট্টহাসি হেসে উপহাস করছেন! তবুও অহং দিয়ে তাঁদের উপেক্ষা করে তিনি কোনরকমে এগোতে এগোতে এক সময় বনঘেঁষা একটি নদীর ধারে এসে পৌঁছলেন। এই নদীর নাম কারও কাছে 'নর্মদা', কারও কাছে 'রেবা'। চোখে মৃত্যুর ছায়া নিয়েও অনেক কষ্টে সেই নদীর জলে তিনি নামলেন, আঁজলা ভরে জল পান করে মৃত্যু নিবারণ করলেন। অবগাহন করলেন। তারপর কোনরকমে পাড়ে উঠে একটা গাছের তলায় এসে গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসলেন।

খানিক পরে সন্ধ্যে হয়ে এল। তখন রাজা দেখলেন নদীতে এসে নামল কয়েকজন দেবকন্যা ও দেবপুত্র। সেদিন একাদশী তিথি। তাই তারা অবগাহন করে শুধু জলপানমাত্র সম্বল করে উপবাসের মধ্য দিয়ে একাদশীর ব্রত রাখল। এবং, হরিনাম করতে করতে রাত্রি জাগরণ করতে শুরু করল। তাই দেখে রাজার মনে এক অদ্ভুত ভাবের উদয় হল, যেন একটা পরিবর্তন ঘটে গেল তাঁর মনে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে গাছের তলা থেকে উঠে এসে তাদের সঙ্গে তিনি সেই ব্রতে যোগ দিলেন। কিন্তু, কঠোর পরিশ্রম ও অনাহারক্লান্ত রাজা রাত্রি জাগরণের কষ্ট আর সইতে পারলেন না। ব্রত শেষ হতে-না-হতেই তিনি মারা গেলেন।

রাজা মারা যেতেই যমদূতেরা নাচতে নাচতে এসে পাপিষ্ঠ রাজাকে যমপুরীতে নিয়ে গেল। শুরু হল মরা মানুষের ঝরা আত্মার বিচার। কিন্তু, বিচার করতে গিয়ে চিত্রগুপ্ত অবাক হয়ে গেলেন। লোকটা সারা জীবনে যা পাপ করেছে, তাতে তো অনন্ত নরকবাসের শাস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু, এ কী! কর্মবিচারে এর ভাগ্যে জুটেছে অনন্তপুণ্য, আর বিষ্ণুপাদপদ্মে অক্ষয় স্থান! এ কী করে হয়!--এই অসম্ভব সম্ভবের কথা যমরাজকে নিবেদন করতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, 'হয় হয়...একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য আর হরিনামের মাহাত্ম্য এমনই যে, পরম পাপীকেও পাপ মুক্ত করে, করে তোলে পরম পুণ্যশীল। একাদশী তিথিতে যদি কেউ একাদশীর ব্রত ভক্তিভরে পালন করেন, তবে তিনি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন এবং বিষ্ণুলোকে বাস করার অধিকার পান।' যমরাজের মুখে এই কথা শুনে যমপুরীতে উপস্থিত সবাই একবাক্যে 'একাদশী ব্রত'-র নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। তখন যম তাঁর দূতদের আদেশ দিলেন রাজা বর্ষকীর্তিকে মহা-সমাদরে বিষ্ণুলোকে পৌঁছে দিতে।

বিষ্ণুলোকে বিষ্ণুর মহিমা কীর্তন ও সেবাকরতে করতে পরম আনন্দে বর্ষকীর্তি দিন কাটাতে লাগলেন। তাঁর মনে তারই মধ্যে একদিন পরহিতের চিন্তা এল। অমনি পদসেবা করতে করতে বিষ্ণুর কাছে করজোড়ে তিনি সে-কথা নিবেদনও করে বসলেন, 'হে প্রভু, পাপিষ্ঠ হয়েও যেভাবে পুণ্য অর্জন করে আজ আমি আপনার চরণসেবার অধিকার পেয়েছি; আপনি যদি আজ্ঞা করেন, তাহলে জগতের মানুষের কাছে আমি সেই পুণ্যপথের কথা প্রচার করে আসতে চাই!' বর্ষকীর্তির কথা শুনে বিষ্ণু প্রসন্ন হলেন। বললেন, 'তোমার যদি সেই অভিপ্রায় থাকে, তবে তাই করো বৎস!'

অতঃপর বিষ্ণুর কৃপায় বর্ষকীর্তি গালব নামের এক মহান ঋষির পুত্র হয়ে জন্ম নিলেন। তাঁর নাম হল, 'ভদ্রশীল'। তিনি পিতার কাছে শিক্ষা পেয়ে বড় হতে লাগলেন। ভদ্রশীল ছিলেন জাতিস্মর। পূর্বজন্মের সমস্তই তাঁর স্মরণে ছিল। তাই সমস্ত শিক্ষা অল্প সময়ের মধ্যেই আয়ত্ত করতে লাগলেন। এবং, বাল্যবয়সেই তিনি সমস্ত শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। এরইমধ্যে একদিন তিনি একাদশী তিথিতে একাদশী ব্রতের আয়োজন করলেন। তাই দেখে ঋষি গালব অবাক হয়ে পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, 'এ-কোন্ নতুন ব্রতের আয়োজন করেছ, পুত্র?' তখন ভদ্রশীল ব্রতের নাম, ব্রতের কারণ, ব্রতের ফল এবং পূর্বজন্মের কথা সমস্তই পিতার কাছে নিবেদন করলেন। সব কথা শুনে গালব একইসঙ্গে চমৎকৃত ও আনন্দিত হলেন। পুত্রের সঙ্গে মোক্ষদায়ী এই নতুন ব্রতে সামিল হলেন। ব্রতপ্রচারের ভার নিলেন। এবং, এভাবেই তাঁদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রচারিত ও প্রচলিত হল একাদশী ব্রত ও ব্রতের মাহাত্ম্য।

 

                                                                   গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বিরচিত, 'নারদীয় পুরাণ'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...