ছোট হয়ে আসা বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নামলেই একা ছাদে জেগে ওঠে আলো। লাল, হলুদ, কেউ বা সবুজ। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। উৎসবের জৌলুস তার নেই। স্থির চোখে যেন তাকিয়ে আছে অনেক দূরের তারার দিকে। চোখে তার অনন্ত অপেক্ষা রাত বাড়লে সব আলো নিভে গেলেও এই আলো নেভে না। মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়া প্রিয়জনের ছায়াপথে আলো দেয়। তাই নিভতে নেই আকাশ প্রদীপকে।
হেমন্তের আঁধারে বাতিঘর হয়ে অপেক্ষা করে আকাশপ্রদীপ। তার আলোয় জেগে থাকে স্মৃতি, অতীতের সত্ত্বা।
শেষ আশ্বিনে ছাদের ওপর বাঁশের খুঁটি বেঁধে দেওয়া হয় টিমটিমে বাল্ব। সাঁঝবেলায় জ্বেলে দেওয়া হয় আলো। চলতি কথায় নাম আকাশ প্রদীপ। পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে শেষ কার্তিক পর্যন্ত গোটা একমাস ধরে আলো দেয়। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় মহালয়ার দিন পূর্ব পুরুষকে উদ্দেশ্য করে তর্পণ করা হয়। তার পরের একটা মাস তাঁরা ফিরে আসেন পৃথিবীর বুকে। উৎসবে সঙ্গী হন। উৎসব শেষ হলে দীপান্বিতা অমাবস্যায় আসে তাঁদের প্রবাসে ফেরার ডাক। অনন্তের একলা পথে কে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাই মর্ত্যের মাটিতে থাকা প্রিয়জনরা তাঁদের পথে ভালবেসে জ্বেলে দেয় সাঁঝবাতি। সেই আলোকে সঙ্গী করে আকাশ গঙ্গায় মেশে হারানো স্বজন। যত দূর চোখ যায় ততদূর থেকে যায় আলো রেখার মায়া টান।
আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ''আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।''
এই আলোয় আবাহন করা হয় বিষ্ণুকেও। আকাশলোকে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করেন তিনি। বিষ্ণু পৃথিবীর প্রতিপালক। জীবের জীবনে তাঁর অধিকার। মৃত্যুর পর অবিনশ্বর জীবনেও অধিশ্বর তিনিই।
আগেকার দিনে ঘি, কর্পুর বা তিল তেল দিয়ে মাটির প্রদীপ জ্বালাই নিয়ম ছিল। মাটির প্রদীপ মানব দেহের প্রতীক। মানব শরীর পঞ্চ ভূত দ্বারা নির্মিত হয়, তেমনি এই প্রদিপ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম অর্থাৎ মাটি ও জল দ্বারা সৃষ্টি হয়। খোলা ছাদে, খোলা আকশে আকাশ প্রদীপের অবস্থান। আগুন আর বায়ু স্পর্শে জ্বলে ওঠে, নশ্বর জীবনের মতোই। নশ্বর দেহের প্রতীক প্রদীপ নিবেদন করা হয় জীবন দেবতাকে।
সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখন বাল্ব আর টুনি লাইট হয়ে উঠেছে আকাশপ্রদীপ। আকাশপ্রদীপের চলও কমে গিয়েছে তুলনামূলকভাবে। কিন্তু একেবারে হারিয়ে যায়নি এই প্রথা। আজও বহু ছাদে কার্তিক সন্ধ্যের মুখে ভেসে ওঠে দীপালিকা...