বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথরের গোপন সুড়ঙ্গ আজও বিস্ময়

বাঁকুড়ার অম্বিকাচরণের রাজা রাইচরণ ধবলদেবের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন সশস্ত্র আন্দোলনের সংগ্রামীরা। ব্রিটিশরা তখন মরিয়া হয়ে বাংলার সশস্ত্র আন্দোলনের মূল উপড়ে ফেলতে চাইছেন। সে সময় কোন জেলার যে জায়গাগুলো একটু ভেতরের দিকে, সহজে পৌঁছানো সম্ভব হয় না সেখানেই নিজেদের গোপন ঘাঁটি তৈরি করতেন বিপ্লবীরা। কিন্তু উনবিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে ব্রিটিশরা এই সমস্ত ঘাঁটি নষ্ট করার ব্যাপারে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। সবচেয়ে সমস্যা হত অস্ত্র তৈরীর ক্ষেত্রে। গোপনে অস্ত্র তৈরি করা এবং তাদের সঠিক জায়গায় সংরক্ষণ করা সে সময় সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রয়োজনীয় নীতি ছিল। কিন্তু ইংরেজদের নজর এড়িয়ে এসব করা কঠিন হয়ে পড়ছিল বিপ্লবীদের কাছে। বাঁকুড়ার রাজা অবশেষে তাঁদের এমন এক জায়গার খোঁজ দেন, যেখানে পরম নিশ্চিন্তে বিপ্লবীরা তাদের গোপন আলোচনা, অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখত নির্ভয়ে।

বাঁকুড়া থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে এই ছেঁদাপাথর  গ্রাম। অরণ্য, পাহাড়, জলাশয় সব মিলিয়ে অপরূপ,  আকর্ষণীয় এক গ্রাম। পাহাড়ি এই গ্রাম ক্ষুদিরামের গোপন অস্ত্রভাণ্ডার ছিল। নির্জন ও নিরাপদ এই গ্রাম হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি। লড়াইয়ের পরিকল্পনা, অস্ত্রভাণ্ডার জমা রাখা সব চলত এখানে।

গবেষকরা বলেন ঊনবিংশ শতকের ওই সময়টা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। এ সময় একাধিক সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথর গ্রামে কালিতলার কাছে বসতো বিশেষ কুস্তির আখড়া। রামদাস চক্রবর্তী সেই আখড়ার মূল নেতা। আখড়া চালানোর আড়ালে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ চলত। যে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা স্বপ্ন ছিল বিপ্লবীদের, তা অর্জন করার লক্ষ্যেই সব প্রস্তুতি চলতো এখানে। এদিকে ব্রিটিশরা তখন সক্রিয় হয়ে উঠছে। বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথর গ্রাম তাদের বিশেষ নজরে ছিল।

বাঁকুড়ার অম্বিকানগরের রাজার কাছে দরবার করেছিলেন বিপ্লবীরা। যেভাবে হোক একটা সুরক্ষিত, নির্জন, গোপন ঘাঁটি ভীষণ দরকার আন্দোলন চালানোর জন্য। রাজা রাইচরণ ধবলদেব নিজেও ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তাঁর নিজের উদ্যোগে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। পাশের জেলা মেদনীপুরেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সমিতি গুলি গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের কাজ করছিল। সকল গুপ্ত সমিতি, গোপন পরিকল্পনা এক ছাতার তলায় আনার লক্ষ্যেই বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথরে বিপ্লবীদের এই গোপন ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল।

রাজা রাইচরণ এবং বাঁকুড়ার হিড়বাঁধে সদ্য কেনা জমিদারির মালিক নরেন গোঁসাই তখন এই ছেঁদাপাথরে বিশেষ জায়গার খোঁজ দিয়েছিলেন। এখান থেকে পশ্চিম দিকে গেলে পুরুলিয়া, দক্ষিণে মেদিনীপুর জেলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা এগোলে বর্তমানের ঝাড়খন্ড এবং সেইসময়ের বিহার।

সমস্ত বিপ্লবীদের পছন্দ হয়েছিল জায়গাটি। ব্রিটিশ পুলিশের চোখের আড়ালে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। অনুশীলন সমিতি সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের গুপ্ত সমিতির বিপ্লবীরা এই ছেঁদাপাথর গ্রামের অদূরে তৈরি করেন গোপন অস্ত্রশিক্ষা শিবির। তবে সুরক্ষার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তাই নরেন গোঁসাই ও রাজা রাইচরণের প্রত্যক্ষ সাহায্যে পাহাড়ি এই এলাকায় একটি গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন বিপ্লবীরা।

গবেষকরা বলছেন মূলত বোমা বা বন্দুক তৈরির অনুশীলনের সময় ব্যবহার করা হতো এই সুড়ঙ্গ। কোন শব্দ যাতে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে সরকারকে সাবধান না করে দিতে পারে তার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছিল এই সুড়ঙ্গ। সম্ভবত ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে বিপ্লবীদের এই গোপন ঘাঁটিতে একাধিকবার এসেছেন বারিন্দ্রনাথ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং প্রফুল্ল চাকির মতো বিপ্লবীরা। ট্রেন ডাকাতির মত অভিযানের পরিকল্পনাও করা হত এই গোপন ঘাঁটিতে।

১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। রাজসাক্ষী হিসেবে তিনি জানিয়ে দেন এই গোপন ঘাঁটির কথা। আজও বাঁকুড়ার ছেঁদা পাথর গ্রামে টিকে রয়েছে বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ও লড়াইয়ের এই স্মৃতিচিহ্ন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...