আমরা জানি একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু, আমরা অনেকেই জানিনা, উনিশে মে-ও ভাষা-শহিদ দিবস। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ের দিন। সে-লড়াইয়ে এ-দিন শহিদ হয়েছিলেন এগারো জন। তাঁদের ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল আসাম-সরকার ও তার পুলিশ বাহিনীর বুলেট। এগারো-শহিদের মাঝে ষোল বছরের এক কিশোরীও ছিলেন। নাম তাঁর, কমলা ভট্টাচার্য। মাতৃভাষার অধিকার চেয়ে, তিনিই বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা-শহিদ।
মহান একুশে, বাহান্নয়। তার আট বছর পরের কথা। ১৯৬০ সাল। আসামে তখন এক-তৃতীয়াংশ বাংলাভাষী মানুষের বাস। কিন্তু, তাদের পাত্তা না-দিয়েই এ-বছরের শেষাশেষি আসামের কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা ঘোষণা করলেন, আসামের সরকারি ভাষা হবে, অসমীয়া। না, তার পাশে সংখ্যা-গরিষ্ঠের ভাষা 'বাংলা'-র কোন স্থান নেই। এরই প্রতিবাদে জনমত গড়ে উঠতে লাগল দ্রুত। সেই জনমত যাতে আন্দোলনের চেহারা না-নিতে পারে, সেজন্য চক্রান্তও হয়ে গেল। জনমানসের উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে তৈরি করা হল, 'জাতি-দাঙ্গা'। প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে একদল অসমীয়া গৌহাটির এক বাংলাভাষী-অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ করলো। ফলে, আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল হিংসা। শুরু হল খুনের রাজনীতি। বাড়ি পুড়ল, জনজীবন বিপর্যস্ত হল। দলে দলে মানুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসতে লাগলেন পশ্চিমবঙ্গে, অনেকেই আশ্রয় নিলেন গিয়ে শিলচর-বরাক উপত্যকায়। এভাবেই শেষ হল ১৯৬০, এলো, একষট্টি।
বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষী মানুষের প্রতিবাদ-অসন্তোষ আন্দোলনের দিকে এগোতে চাইল। ৫ ফেব্রুয়ারি, গড়ে উঠল সংগঠন, 'কাছাড় গণ-সংগ্রাম পরিষদ'। সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হতে লাগলো বাংলাকেও সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ক্রমাগত আর্জি। কিন্তু, তাতে কর্ণপাতই করলো না আসাম-সরকার। এই অবজ্ঞাই আন্দোলনকারীদের সত্যাগ্রহের পথে নামতে বাধ্য করলো। শুরু হল দু'শো মাইল বিস্তৃত বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষকে মাতৃভাষার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ। শুরু হল পদযাত্রা। পরিষদ ও আন্দোলনের নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন স্পষ্টই ঘোষণা করলেন, তেরো মে-র মধ্যে তাঁদের দাবী যদি পূর্ণ না-হয়, তাহলে ১৯ মে রাজ্যজুড়ে পালিত হবে সর্বাত্মক ধর্মঘট। কিন্তু, তাতেও সরকারের টনক নড়ল না। উল্টে, ১৮ মে রবীন্দ্রনাথ সেন সহ আরও দুই নেতাকে পুলিশ আটক করলো। অবশ্য, তাতে সংগঠিত-আন্দোলনের কর্মসূচিকে আটকানো গেল না।
১৯ মে সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা সরকারি অফিস-আদালত-রেল স্টেশন সর্বত্রই দলে দলে অবস্থান করে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট শুরু করলেন। সারাটি সকাল নির্বিঘ্নেই কাটল। কিন্তু, অশান্তি শুরু হল দুপুরে। শিলচর স্টেশনে। আর দেড়-দু'ঘন্টার মধ্যেই হয়তো ধর্মঘট উঠে যেত। কিন্তু, তার আগেই ঘটনাটা ঘটল। স্টেশনে এসে পড়ল পুলিশের একটি পল্টন। ন'জনের মতো ধর্মঘটিকে গ্রেপ্তার করে একটি ট্রাকে তুলল। তবু, নিয়ে যেতে পারলো না। পথ আটকে দাঁড়ালেন ধর্মঘটিরা। পুলিশ যাঁদের গাড়িতে তুলেছিল, তাদের নামিয়ে দিতে বাধ্য হল। ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। আর তাতেই পুলিশ সুযোগ পেয়ে গেল রুদ্রমূর্তি ধরার। নির্বিচারে শুরু হল ধর্মঘটিদের ওপর লাঠিচার্জ। গড়ে উঠল পাল্টা প্রতিরোধ। চালানো হল সতেরো রাউন্ড গুলি। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়লেন ন'জন। আরও দু'জন মারা গেলেন খানিক পরে। মোট এগারো। কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য।
বরাকে এগারো জন ভাষা-শহিদের রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা 'বাংলা' তার অধিকার পেল। বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা হল। শিলচর স্টেশনের নাম, 'ভাষা-শহিদ স্টেশন' হল। স্টেশনে শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হল। কিন্তু, কমলারা দেখে যেতে পারলেন না, তাঁদের জয়। জানতেও পারলেন না, রক্ত দিয়ে তাঁরা আমাদের কী দিয়ে গেলেন! তাই আজ উনিশে মে তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর দিন, তর্পণের দিন :
"দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, ‘এই যে ঈশান কোণ—
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন।’
শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা---
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।”
(কবি: শক্তিপদ ব্রহ্মচারী; কবিতা : 'উনিশে মে ১৯৬১ শিলচর')