আচ্ছা বিজ্ঞানী বললে ঠিক কেমন চেহারা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে বলুন তো? বেশ একজন কেতাদুরস্ত মানুষ। চোখে জোরালো পাওয়ারের চশমা, গম্ভীর। কোনো এক বিখ্যাত গবেষণাগারে মুখ গুঁজে নিশ্চয়ই সারাক্ষণ বিজ্ঞানের গূঢ় রহস্যগুলো নিয়ে চর্চায় মেতে থাকেন। সঙ্গী অবশ্যই কোন রোবট-টোবট জাতীয় যন্ত্র। এমন ছবিটাই ভেসে ওঠে তাই না?
কিন্তু ছবিটা যদি এরকম না হয়?
Read Also : “জ্বলে যাচ্ছে পৃথিবীর ফুসফুস, প্রার্থনার থেকেও বেশি কিছু প্রয়োজন এখন আমাজনের”: লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও
তাহলে কেমন হয় ?
এক অসম্ভব মেধাবী ও অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় বিজ্ঞানী। মেজাজ তাঁর রাজার মত। ঠিকানা বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেস-বাড়ি। সেখানে চার 'সভাসদ' নিয়ে তাঁর ওঠাবসা। তবে পৃথিবীতে বিজ্ঞান কোন সময়ে কোন রহস্যজালে পাক খেতে থাকে তা এই বিজ্ঞানীর নখদর্পনে। এই মানুষটির একমাত্র লক্ষ্য বিজ্ঞানের যে কোনো কুপ্রভাব থেকে মানবজাতিকে বাঁচানো। সে যেন এক যোদ্ধা। নিরন্তর যুদ্ধ করে চলে খারাপ শক্তির বিরুদ্ধে, মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য। মেধা এবং সাহস তাঁর অস্ত্র। এই বিজ্ঞানীর নাম ঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদা।
তবে বিজ্ঞানীটি এক কাল্পনিক চরিত্র। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কলমে ঘনাদার আবির্ভাব এক বড় জটিল সময়ে। ১৯৪৫ সালের ১৫ অগস্ট। অ্যাটম বোমায় বিধ্বস্ত জাপানের আত্মসমর্পণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছিল এই সময়।
মানবজাতির কাছে বিজ্ঞান তখন আতঙ্কের বিষয়। বিজ্ঞানের সঙ্গে মানুষের ভাল করার ইচ্ছেকে না মেশালে সে করাল রূপ ধারণ করতে পারে। তার ক্ষমতা তখন সর্বগ্রাসী। অ্যাটম বোমার আঘাতে আতঙ্কিত মানুষ বোধহয় বিজ্ঞানকে আর ভরসা করতে পারছিল না।
কিন্তু বিজ্ঞান তো আলোর মত। সমাজের অন্ধকারকে মোছাতে পারে। তবে মানুষ এর কুপ্রভাব নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
প্রেমেন্দ্র মিত্র বুঝেছিলেন সেই টালমাটাল অবস্থা। তখনই তিনি রচনা করলেন ঘনাদা চরিত্র। যাঁর মূল লক্ষ্য বিজ্ঞানকে মানুষের অনিষ্ট না করতে দেওয়া।
১৯৪৫ সালের দেব সাহিত্য কুটিরের বিশেষ পূজাবার্ষিকী সংখ্যার নাম ছিল 'আলপনা'। প্রথমবার সেখানে প্রকাশিত হল ঘনাদার গল্প। নাম 'মশা'। সেখান থেকেই শুরু। প্রতিবছর দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে একটি করে ঘনাদার গল্প প্রকাশিত হতো।
ঘনাদার গল্পগুলো কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী হলেও বড় সহজ। কোন দুর্ধর্ষ অতি-মানব নেই। অতিপ্রাকৃত কিছুও এখানে সেভাবে স্থান পায়নি। শুধু মানুষের ভালো করার লক্ষ্যে নানা দুঃসাহসিক অভিযান করে বেরিয়েছেন ঘনাদা।
ঘনাদা চরিত্রকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। 'মশা' গল্পে প্রথম প্রবেশ করে সেখানে ঘনাদার চরিত্র খানিকটা নির্মীয়মান। ষষ্ঠ গল্প 'টুপি'তে পাঠক জানতে পারে ঘনাদার মেস-বাড়ির ঠিকানা।
এইভাবে এক-এক বছরে এক একটি গল্পে লেখক গড়ে তুলেছিলেন ঘনাদার বিপুল ঐতিহ্য।
প্রেমেন্দ্র মিত্র বরাবরই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করার লক্ষ্যেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই চরিত্র। তবে যেকোনো বয়সের পাঠকই ভালবেসেছে ঘনাদাকে।
ঘনাদা তুখোড় সাহসী, মেধাবী, বিজ্ঞানমনস্ক হলেও তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে নেওয়া যায়। তাই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্পগুলো কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হলেও তারা পাঠকের বড় কাছের। নেই কোনো কৃত্রিমতা। যেমন ঘনাদার মেসবাড়ির গৌর, শিশির, শিবুও কখন যেন আপনজন হয়ে ওঠে।
আবার এই আশ্চর্য বিজ্ঞানী মানুষটি অন্য দুষ্টু বৈজ্ঞানিককে শায়েস্তা করতেও ভয় পাননি কখনো। তাই তো অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন ''ঘনাদার জন্য তার স্রষ্টার নাম চিরস্থায়ী হবে''।
ঘনাদার শেষ গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে।
ঘনাদার বয়স নিয়ে নানা কৌতুক রয়েছে গল্পে।
আসলে এমন ছায়ার মত আপনজনের বয়স বোধহয় কখনোই চরমে পৌঁছয় না। এভাবেই আমাদের ছেলেবেলারস্মৃতি, বিজ্ঞানের সুচিন্তা আঁকড়ে ঘনাদা বেঁচে রয়েছে পাঠকের অন্তরে।