গঙ্গাবাঈয়ের পাঠশালা

মহিলারা যখনই কোনো বীরত্বের কাজ করেন, আমরা তাঁর তুলনা করি ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ-এর সাথে, গোটা দেশের কাছেই 'ঝাঁসির রানী' শব্দটি একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্যের মতোই হয়ে গেছে, কিন্তু ঝাঁসির রানী যখন অস্ত্রশিক্ষা করছেন, ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, অসিচালনা করছেন পুরুষযোদ্ধাদেরই মতন তখন তার সাথেই তারই মতন আর একজন রমণীও থাকতেন, তিনি ছিলেন লক্ষীবাঈয়ের নিরন্তর সহচরী গঙ্গাবাঈ। সম্পর্কে লক্ষীবাঈ ছিলেন গঙ্গাবাঈয়ের মাসিমা, বয়সেও ছিলেন সমবয়স্কা। সিপাহী বিদ্রোহের দিনগুলিতে গঙ্গাবাঈয়ের অসামান্য বীরত্বের কথা আজ অনেকেই জানেন না বটে তবে এতে ওঁর কৃতিত্ব কিছুতে কম হয়না। বিদ্রোহে পরাজয়ের ফলে রাজ্য হারা হলেন গঙ্গাবাঈ, পালিয়ে গেলেন নেপাল, সঙ্গী ছিলেন নানাসাহেব, প্রায় তিরিশ বছর আত্মগোপন করে থাকার পর আশির দশকের শেষ দিকে হঠাৎ হাজির হলেন আমাদের শহর কলকাতায়। তখন শারদ উৎসবের সময়, বিজয়ার দিন গঙ্গাবাঈ রাস্তায় দঁড়িয়ে আছেন আর দেখছেন কলকাতার প্রতিমা বিসর্জন পর্ব।

      গঙ্গাবাঈ-এর পাশেই দাঁড়িয়ে বিসর্জন দেখছিলো কয়েকজন ছোট ছোট মেয়ে, তাদেরই একজন হঠাৎ বলে উঠলো এই প্রতিমা পুজো বা পৌত্তলিকতার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, কথাটা কানে এসে বিঁধলো গঙ্গাবাঈয়ের, বুঝলেন এতে মেয়েগুলির কোনো দোষ নেই, দোষ মিশনারী শিক্ষা পদ্ধতির। ঠিক করলেন মেয়েদের জন্যে একটা স্কুল খুলবেন কলকাতায় যেখানে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি দেওয়া হবে ভারতীয় সনাতন ধর্মের আদর্শবোধ। আপার সার্কুলার রোড যা বর্তমানে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোড নামে পরিচিত, সেখানেই কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ীর বাড়িতেই ১৮৯৩সনে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি অবৈতনিক স্কুল শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য, নাম দিলেন মহাকালী পাঠশালা। ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকায় গঙ্গাবাঈ খোঁজ করতে থাকলেন নতুন ভবনের, জায়গা পাওয়া গেলো চোরবাগানের মল্লিকবাড়ির পাশেই, তারপর সেখানেই কিছুদিন ক্লাস চলার পর স্কুল উঠে এলো সুকিয়া স্ট্রীটে| এখন  সেই অংশটির নাম পাল্টে কৈলাশ বসু স্ট্রীট হয়ে গেছে। প্রায় এগারো কাঠা জমির ওপর স্কুলের স্থায়ীভবনের প্রতিষ্ঠা করেন গঙ্গাবাঈ, তখন স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০জন

      যেসব ছাত্রীরা দূরে থাকতো তাদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য দুটো ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছিল। পাঠশালার প্রয়োজনীয় বইয়ের জন্য ছিল নিজস্ব ছাপাখানা, একটি পত্রিকাও ছিল মহাকালী পাঠশালার। মহাকালী পাঠশালায় সেইসময় প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী অবধি পাঠের ব্যবস্থা ছিল। স্কুলের মেয়েদের শিখতে হতো রান্নাবান্না, আষাঢ়-শ্রাবন কি বৈশাখের মাস গুলিতে তেরো পার্বনের নিয়ম, আচার-বিচার। ক্লাসে পড়ানো হতো 'যাদুগোপালের প্রথম পাঠ', 'বোধোদয়', 'রঘুবংশ', 'সীতার বনবাস', 'ঋজুপাঠ', 'সাধ্বী সদাচার', 'রামায়নী কথা', 'বেহুলা', এবং 'স্তবলহরী'। পার্বনের নিয়ম শুধু জানলেই হতোনা, পালনও করতে হতো। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে প্রত্যেক ছাত্রীকে নিজের হাতে তৈরি করতে হতো শিব ঠাকুরের মূর্তি, তারপর করতে হতো পুজোপাঠ, দুপুরে চলতো কুমারী ভোজন। আষাঢ় মাসে গুরু পূর্ণিমা, আশ্বিনে দূর্গাপুজো, বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো এই সব উৎসবই হতো ধুমধামের সাথে, থাকতো এলাহী ভোজের আয়োজনও| প্রতি বছরে শেষে হতো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, আর সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেন স্বয়ং বড়লাট, ছোটলাট, দ্বারভাঙা কিংবা বর্ধমানের মহারাজারাও, পুরস্কার হিসেবে থাকতো স্বর্ণ পদক, রৌপ্য পদক, ভালো বই, ভালো রেশমের শাড়ি, সোনার গহনা, পুজোর বাসন ইত্যাদি, সমস্ত ছাত্রই কিছু না কিছু পুরস্কার পেতই| অনেকেই মনে করেন ভগিনী নিবেদিতা এই পাঠশালার থেকেই পেয়েছিলেন নিজের স্কুল তৈরীর অনুপ্রেরণা। বিধানসরণির ওপরে যে শ্রীমানী মার্কেট ঠিক তার উল্টো দিকে কৈলাশ বসু স্ট্রীটের রাস্তা ধরে আমহার্স্ট স্ট্রীটের দিকে মিনিট খানেক হাঁটলেই রাস্তার বাঁদিকে এখনো দেখতে পাবেন মাতাজির স্কুল, তবে আজ তার নাম "আদি মহাকালী পাঠশালা"।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...
slidesToShow: 2, slidesToScroll: 1 } } ] }); /****tag-carousel ends****/