বাগান বাড়ি থেকে নাট্যশালা

আঠারো শতকের মধ্যভাগ। সে সময় কলকাতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রঙ্গমঞ্চ। কিন্তু সে সময় রমরমা ইংরেজি থিয়েটারের।  ব্যক্তিগত নাট্যশালাও গড়ে উঠছে। কলকাতার বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদের উদ্যোগে। কালীপ্রসন্ন সিংহ উত্তর কলকাতায় নিজের বাসভবনে নাট্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে মঞ্চস্থ হল বাংলা নাটক। কিন্তু তা ইউরোপীয় ধাঁচের। আরও বেশ কয়েকটি রঙ্গালয় গড়ে উঠল।

এই সমসাময়িক সময়েই উত্তর কলকাতায় গড়ে ওঠে এরকমই এক ব্যক্তিগত নাট্যশালা। স্ফুলিঙ্গের মত তার আগমন, উত্থান এবং সেভাবেই তার হঠাৎ নিভে যাওয়া। আকস্মিক নিভে গেলেও সেই নাট্যশালা বাংলার নাটকের ইতিহাসে মুক্ত ধারার প্রবাহ এনেছিল। বদলে গিয়েছিল বাংলা রঙ্গমঞ্চের ভাবনার গতিপথ।     

উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার সিংহ রাজপরিবারের রাজা প্রতাপচন্দ্র ও তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ তাঁদের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করলেন। নাম দিলেন 'বেলগাছিয়া নাট্যশালা' ।

নাট্যশালা নির্মাণে অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর।কিন্তু নাট্যশালা নির্মাণেই থেমে গেলে হল না। মঞ্চায়নের জন্য চাই আনকোরা নাটক। নতুন কাহিনী। কিন্তু ইংরেজি নাটকের অনুবাদ নয়। নাট্যশালার কর্নধাররা ঠিক করলেন সংস্কৃত নাটকের অনুবাদকে মঞ্চে আনবেন তাঁরা। সে ভাবনা থেকেই বেছে নেওয়া হল শ্রীহর্ষের রত্নাবলী। শ্রীহর্ষের রত্নাবলী অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জুলাই, শনিবার এই নাট্যশালায় প্রথম অভিনীত হয় 'রত্নাবলী'। এই নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমেই নাট্যশালার উদ্বোধন হয়। পরবর্তী সময়ে নাটকটি বেলাগাছিয়া নাট্যশালায় প্রায় ছয়-সাত বার অভিনীত হয়েছিল। বাংলার ছোটলাট স্যার ফ্রেডরিক হ্যালিডে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এই নাট্যশালার প্রথম মঞ্চাভিনয়ের দিন উপস্থিত ছিলেন।

পাইকপাড়ার রাজা, বেলগাছিয়া নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ নিজে এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। নাটকের অন্য অভিনেতারা সকলেই নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক বাঙালি।  রত্নাবলী নাটকে বিদূষক বসন্তের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘বাংলার গ্যারিক’।  

মূল নাটকটি ছিল সংস্কৃতে। তার বঙ্গানুবাদ করা হয়। কঠিন বঙ্গানুবাদ। স্বাভাবিক ভাবেই তার রস গ্রহণ বেশ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে ইংরেজ দর্শকদের জন্য। সেই কারণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটির সারাংশ তৈরি করেন। সেটি ছেপে ইংরেজ দর্শকদের মধ্যে বিলি করা হয় নাটক শুরুর আগে। এদেশে দর্শকদের মধ্যে এভাবে কাগজে ছেপে নাটকের সারাংশ বিতরনের ঘটনা এই প্রথম। ভাবনা নিঃসন্দেহে আধুনিক। আজও ভিন্ন ভাষার নাটক দেখার ক্ষেত্রে দর্শকদের সুবিধার জন্য এভাবে সারাংশ বিলির প্রথা চলে আসছে।

মধুসূদনের ইংরেজি সারাংশ উচ্চপ্রশংসিত হলো ইংরেজ দর্শকদের মধ্যে। ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজী অনুবাদের মধ্য দিয়েই তিনি কলকাতার অভিজাত মহলে সুপরিচিত হলেন। 

রত্নাবলী’ নাটকের মহলায় প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন মধুসূদন দত্ত।  কিন্তু বেশ হতাশ হতেন। সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা নাটকের দুর্বলতা চোখে পড়ত। দুর্বল নাটকের জন্য নাট্যপ্রেমি ধনী ব্যক্তিদের অর্থব্যয়ে আফসোসও হত!নাট্যশালার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন বন্ধু গৌরদাস বসাক। তাঁকে লেখা এক চিঠিতে মধুসূদন ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর হতাশার কথা,  ‘হোয়াট এ পিটি, দি রাজাস সুড হ্যাভ স্পেন্ট সাচ এ লট অফ মানি অন সাচ এ মিসারেবল প্লে”। 

সেই হতাশা থেকে বেরতেই বোধহয় জন্ম ‘শর্মিষ্ঠা’র। মধুসূদনের লেখা প্রথম বাংলা নাটক। প্রথম বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যেরও সূচনা করলেন।

'শর্মিষ্ঠা' নাটকের কাহিনি মহাভারতের আদিপর্বের 'যযাতি-দেবযানী' উপাখ্যান থেকে নেওয়া হয়।

১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর এই নাটকটি এই নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়েছিল।

সেই প্রথম মৌলিক বাংলা নাটক বাঙালির প্রতিষ্ঠিত নাট্যমঞ্চে। তারপর পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রিয়নাথ দত্ত, হেমচন্দ্র মুখার্জী,  গৌরদাস বসাক, কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী, মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর,  রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ অভিনেতা মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন।  সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বাংলা থিয়েটারে এই প্রথম ভারতীয় ঐকতান বাদন ব্যবহার হয়। এতে নেতৃত্ব দেন  ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী  যদুনাথ পাল।

‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পুরোদস্তুর মঞ্চ সফল নাটক বলা যায়।

 তৎকালীন সংবাদ প্রভাকর ও হিন্দু পত্রিকায় বেলগাছিয়া থিয়েটারের অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে বেলগাছিয়া থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।

 এর ষষ্ঠ এবং শেষ অভিনয় হয়েছিল এই বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর।

শর্মিষ্ঠার পরে এই নাট্যশালায় আর কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয় নি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের অকাল মৃত্যুর পর, এই নাট্যশালা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

 

( ছবি প্রতীকী)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...