বসন্তের অন্যতম বৃহৎ উৎসব হল শিব চতুর্দশী। বসন্ত হল বাঙালির শৈব আরাধনার সময়। বঙ্গের সংস্কৃতিতে মিশেছেন শিব। কালীর দেশে বঙ্গ। শিব হলেন সেই কালীর ভৈরব। কাল শিবহ্। তস্য পত্নতি কালী। শিবের আরেক নাম কাল এবং তাঁর স্ত্রী কালী। আদ্যাশক্তি মা কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি। কাল-কে ধারণ করেই তিনি কালী হয়েছেন। কালী শব্দটি হল কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার আরেক অর্থ কৃষ্ণ বা ঘোর বর্ণ। আবার কাল সময় অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মৃত্যু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সে'কারণেই শিব মহাকাল।
বাঙালির মহাকাল শিবের পেশীর বাহুল্যতা নেই। গাত্রবর্ণ নীল নয়। সুঠাম দেহের অধিকারী তিনি নন, তিনি মোটাসোটা। তিনি গোঁফ রাখেন, কলকে টানেন আবার পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রাঁধতে বলেন। আসলে বঙ্গের লোকায়েত দর্শনে শিব মিশেছেন, কোথাও তিনি ক্ষেত্রপাল আবার কোথাও তিনি পঞ্চানন ঠাকুর। বাংলার ঘরের শিব মঙ্গলকাব্য ও লোকসংস্কৃতির দৌলতে পাঁচু ঠাকুর, চাঁদ রায়, ধর্ম ঠাকুর, ক্ষেত্রপাল প্রমুখের মাধ্যমেই হয়ে উঠেছেন সকলের ভোলানাথ। জেলেদের মাকাল ঠাকুরও তিনি। লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পরবর্তী আমলে চাষা শিব-এর জন্ম। তিনি মাটি কর্ষণ করেন, ত্রিশূল বন্ধক রেখে লাঙ্গল কেনেন, ফসলও ফলান। একেবারে ঘরোয়া সংসারী মানুষ হয়ে উঠছেন শিব। কালী তাঁর বুকের উপর দন্ডায়মানা।
শ্মশানবাসী কালী থেকে মুক্তকেশী, দিগম্বরী, গৃহীর আরাধ্যা শ্যামা কালী থেকে ডাকাতদের আরাধ্যা কালিকা, সর্বত্রই পতি শিবের বুকের উপর কালী দন্ডায়মান। কালীকে নিরস্ত্র করে প্রলয় থামিয়ে জগৎকে শান্ত করতে মহাকাল শিব কালীর পদতলে চলে গিয়েছিলেন। একমাত্র উল্টো ছবি দেখা যায় বাংলায়। কারণ, বাংলা বৈচিত্রে অন্যন্য।
মধ্যমগ্রাম বাদু রোডে রয়েছে বাব মহাকাল মন্দির। সেই মন্দিরে কালীর বুকের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেবাদিদেব শিব। নীচে মা। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এই রূপেই পূজিতা হচ্ছেন শিব। প্রথমে ক্যালেন্ডারে পুজো হত। তারপর মূর্তি আসে। মহাদেব এখানে চতুর্ভুজ, নীল তাঁর দেহের রঙ। শিবের সঙ্গে সর্প থাকে। তিনি দক্ষিণা কালীর দেহে পা রেখে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ সাধারণ কালী মূর্তির একেবারে উল্টো অবস্থান। পদতলে থাকা দেবী কালিকার গাত্রবর্ণ নীল। দেবী চতুর্ভুজা। গলে থাকে মুণ্ডমালা। এমন মূর্তির পুজো কোথাও হয় না। এ মূর্তি তর্কাতীতভাবে হয়তো শাস্ত্র সম্মতও নয়। ব্যতিক্রমী মহাকালের মূর্তি ভূ-ভারতে রয়েছে মাত্র তিনটি। বেনারস, উজ্জয়িনী এবং মধ্যমগ্রামে। পূর্ণাঙ্গ মূর্তি কেবল মধ্যমগ্রামেই দেখা যায়। এই মূর্তি প্রকৃতি আর পুরুষের ভারসাম্যের প্রতীক। এখানে প্রকৃতি হল নারীর প্রতিরূপ।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, আটের দশকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার বাড়িতে মহাদেব ও কালী এমন ভঙ্গিতে ছবি-সম্বলিত ক্যালেন্ডার উড়ে এসে পড়ে। স্বপ্নে এই মূর্তি প্রায়ই দেখতে পেতেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় ঠাকুরের ভোগ হয়। নিয়মিত যজ্ঞ হয়। নিত্য পুজো চলে।