আঠেরো শতকের শেষদিকে বাংলায় যখন এশিয়াটিক সোসাইটি তৈরি হয়ে গেছে; তখন শ্রীরামপুরে এক যুবক এলেন, ডেনমার্ক থেকে। নাম, নাথানিয়েল ওয়ালিক। পেশায়, বোটানিস্ট। শ্রীরামপুরে আসার একটাই কারণ, জায়গাটা ড্যানিশদের দখলে। ফলে, স্বজাতীয়ের কাছে কাজ পাওয়াটা সহজ হবে। হলও তাই। নাথানিয়েল ব্যাপক করিৎকর্মা লোক। অল্পদিনেই তিনি সেকালের কলকাতা ও শ্রীরামপুরের পণ্ডিতমানুষদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে ফেললেন। উইলিয়াম কেরি, সংস্কৃতভাষাবিদ কোলব্রুকের বজম-বন্ধু এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বেশ একজন হোমরাচোমরা হয়ে উঠলেন। তবে এশিয়ার লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গাছপালা-পশুপাখির প্রতি ভদ্রলোকের টান ছিল ষোলআনা আন্তরিক। সেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এসবের ফসিল এবং নমুনা কিছু কিছু নিজের সংগ্রহে জমতে লাগল। ইতিমধ্যে ১৮১৩-তে শ্রীরামপুর কবজা করে ফেলল ইংরেজরা। পরিচিতির জোরে নাথানিয়েলের অন্তত তাতে অস্তিত্বের সংকট দেখা দিল না। বরং, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেই বোটানিক্যাল সার্ভেয়ারের চাকরি জুটিয়ে ফেললেন এবং চুটিয়ে কাজ শুরু করলেন। বুঝলেন, এবার এশিয়ার প্রকৃতি-সম্পদের ইতিহাস রক্ষায় কিছু একটা অন্তত করা উচিত। সে-ব্যাপারেই প্রস্তাব দিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির একজন হর্তাকর্তা কোলব্রুককে একখানা চিঠি লিখে ফেললেন। লিখলেন, "the deplorable neglect to which the natural history of this country has been exposed" এবং এটা হচ্ছে শুধুমাত্র সাধারণের জন্য একটা মিউজিয়াম গড়ে ওঠেনি বলেই। আসলে, ব্যাপারটা এশিয়াটিক সোসাইটিকেও ভাবাচ্ছিল অনেকদিন ধরেই, নাথানিয়ালের চিঠিটি এবার নড়েচড়ে বসার রসদ জোগালো।
তার ফলে, ১৮১৪-তেই এশিয়াটিক সোসাইটির অধীনে, সোসাইটির বাড়িতেই শুরু হল মিউজিয়াম। তাকে কেউ বলতে লাগলেন, ওরিয়েন্টাল মিউজিয়াম; কেউ বা, ইম্পিরিয়াল মিউজিয়াম। অবিলম্বে তাতে যুক্ত হল নাথানিয়েলের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। তাঁর তত্ত্বাবধানে সংগৃহীত হতে লাগল পুথি, ভাস্কর্য, শিলালিপি, তাম্রপত্র, প্রত্নবস্তু, প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, প্রাণী বা উদ্ভিদের ফসিল-চামড়া-দেহ-দেহাংশ প্রভৃতি। সংগ্রহ বাড়তে বাড়তে কয়েক বছরের মধ্যেই জায়গার অভাব দেখা দিল। এবং, মিউজিয়ামটি নিছক একটি গোডাউনে পরিণত হল। নাথানিয়ল উৎসাহী ছিলেন, সংগ্রাহক ছিলেন; কিন্তু, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সুশৃঙ্খলভাবে মিউজিয়াম সাজানোর শিক্ষা তাঁর ছিল না। তাছাড়া, তাঁর নিজের সার্ভের কাজও ছিল, ফলে, মিউজিয়ামের জন্য পুরো ও নিয়মিত সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই কয়েক বছর পর মিউজিয়াম দেখভালের দায়িত্ব পালা করে যেতে লাগল বিভিন্ন জনের হাতে। তিনি রইলেন পরিচালন সমিতির একজন হয়ে। এই রকম তালগোল পরিস্থিতিতেই একদিন হারিয়ে গেল বদ্রিনাথ মন্দির থেকে পাওয়া প্রাচীন তাম্রলিপি। ফলে, সোসাইটি নড়েচড়ে বসল। নড়াই সার হল, পদক্ষেপ আর হল না। তারমধ্যেই ১৮৪০ সাল নাগাদ রানীগঞ্জে কয়লাখনির প্রসারে খোঁড়াখুঁড়ির সময় বেশকিছু মূল্যবান ভূতাত্ত্বিক নমুনা পাওয়া গেল। সেসব এসে জুটল সোসাইটির মিউজিয়াম-নামক গুদামে। সেইসঙ্গে সমানে সেখানে নিত্য ঠাঁই পেতে লাগল মূল্যবান সব প্রত্ন ও ঐতিহাসিক সামগ্রী। গলে গেল আরও আঠেরোটা বছর। তবে গিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি দেশের সরকারের কাছে পাবলিক মিউজিয়াম তৈরির অনুমতি চেয়ে আবেদন জানাবার সময় পেলেন। দু'বছর লেগে গেল লালফিতে পেরিয়ে অনুমতি পেতে। মিউজিয়ামের বাড়িটির প্ল্যান তৈরি করলেন সেকালের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ওয়াল্টার গ্রানভিল সাহেব। মিউজিয়ামটির নাম দেওয়া হল, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। ১৮৬৬-তে আইন করে এশিয়াটিক সোসাইটির হাত থেকে ভারত সরকার মিউজিয়ামটি নিজের অধীনে নিয়ে নিলেন। পরিচালনার ভার রাখলেন ট্রাস্টিদের হাতে। এবং, ১৮৭৫ সালে খুলে দিলেন সাধারণের জন্য। প্রায় পঞ্চাশ বছরের প্রচেষ্টায় এভাবেই ধাপে ধাপে গড়ে উঠল কলকাতার গর্ব এবং এশিয়ার প্রথম মিউজিয়াম। ১৮১৪-কে জন্মবছর ধরলে, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম কিন্তু ইতিমধ্যেই পার করে ফেলেছে দুশো বছরের পথ, আর বুকে বয়ে চলেছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। সেইসঙ্গে ইতিহাসের এই সংগ্রহশালার রূপকার হিসেবে অমর হয়ে রয়েছে নাথানিয়েল ওয়ালিকের নাম।
সাধারণ বাঙালির জীবনে একটি বিশিষ্ট দর্শনীয়স্থান হিসেবে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বা ভারতীয় জাদুঘর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রেও। শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর সরস গদ্যের রসিকতায় 'মামির বাড়ির আবদার'-গল্পে হর্ষবর্ধন, তস্য ভ্রাতা গোবর্ধন, নিজস্ব পত্নী এবং তৎসহ আমাদেরও যেভাবে মিউজিয়ামের মমি দর্শন করিয়েছেন, তা এককথায় অনবদ্য। একটু উদ্ধৃতি দিই :
হর্ষবর্ধন বউ ও ভাইকে বললেন :"যাদুঘরে থাকে যে মিশরের মামি সে-ই মামি আজ তোদের দেখিয়ে আনব চ।'...
যাদুঘরে গিয়ে মমি দেখে ত গোবরার বৌদি হতবাক!--'ওমা, এই তোমার মামির ছিরি! এই তোমার মিশরের মামি?'...
মমির কফিনের গায়ে একটা টিকিট লাগান ছিল, তাতে লেখা--B.C.2299; গোবরা সেইদিকে দাদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে : 'এটা কি গো দাদা? কিসের নম্বর?'
দাদারও চোখ পড়েছিল টিকিটটায়। তিনি মাথা নেড়ে বললেন : 'এটা আর বুঝতে পারছিসনে হাঁদা?...যে মোটর চাপা পড়ে মেয়েটি মরেছিল এটা হচ্ছে সেই গাড়ির নম্বর রে।"
বাংলা চলচ্চিত্রেও ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম আছে। মৃণাল সেনের হাতে সে দারুণ সিম্বলিক 'ইন্টারভিউ' ছবিতে। সেখানে, চাকরির ইন্টারভিউর পর রঞ্জিত প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করছেন মিউজিয়ামে। অদূর ভবিষ্যতে যার স্বপ্ন ব্যর্থ বলে ঘোষিত হবে, যার ব্যর্থ জীবনে প্রেম মরে ফসিল হবে; ফসিল ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে যে তার হারিয়ে যাওয়া মৌল সত্তাটিকে উপলব্ধি করবে, লড়াইয়ের জন্য একাই রুখে দাঁড়াবে--মিউজিয়ামে তার উপস্থিতি অনিবার্য। কারণ, এতগুলো ব্যঞ্জনা একসঙ্গে মিউজিয়াম ছাড়া আর কে তুলে ধরবে! কে ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র তৈরি করে ভবিষ্যতের আভাস দেবে! কেউ না।