এ রাস্তায় থাকতেন ব্যোমকেশ বক্সি! সে কি কম কথা! ১৮৮৮ সালে কলকাতার সঙ্গে এন্টালি, বেনেপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা, আলিপুর ও খিদিরপুরকে সংযুক্ত করা হয়। সেই সময়ে ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা রোড, আপার সার্কুলার রোড, কালিটেম্পল রোড, গোপালনর রোড ইত্যাদি রাস্তা তৈরি হয়েছিল। ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮২ মাইল। তখন সড়ক পথের পাশাপাশি কলকাতার রেলপথও গড়ে উঠছিল।
১৮৫৪ সালের ১৬ই এপ্রিল হাওড়া থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সে সময়ে টিকিটঘর ছিল আর্মেনিয়ান ঘাটে। হাওড়ায় ট্রেন ধরার জন্য, সেখান থেকে টিকিট কেটে স্টিমারে গঙ্গা পেরোতে হত। হাওড়া ব্রিজ তৈরি হয়েছে অনেক পরে, ১৯৪২ সাল নাগাদ। তার আগে গঙ্গা পেরনোর জন্য পন্টুন ব্রিজ ছিল। শিয়ালদহ স্টেশন তৈরি হয় ১৮৬৯ সালে, কিন্তু শিয়ালদহ থেকে হাওড়া যাওয়ার কোনও সড়ক পথ ছিল না সেই সময়। হ্যারিসন রোড তৈরি হয় ১৮৮৯ সালে। এই হ্যারিসন রোডই কলকাতার প্রথম রাস্তা, যেখানে বৈদ্যুতিক আলোর বাতিস্তম্ভ বসেছিল।
ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার জন্যেই কলকাতাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল, গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের মনের মতো করেই। কলকাতাকে সাজানোর নেপথ্যে ছিল তাঁদের নাম ও স্মৃতিকে অক্ষয় অমরত্ব প্রদান করা। তাই তো আজও তিলোত্তমার রাস্তা-ঘাট-মোড়-পার্কে ইংরেজদের ছোঁয়া বিদ্যমান।
তেমনই এক রাস্তা হল হ্যারিসন রোড। যদিও বর্তমানে এই রাস্তার নাম জাতির জনকের নামে নামাঙ্কিত; মহাত্মা গান্ধী রোড, এমজি রোড। ভারত তথা বাংলার লাইফ লাইন হল রেল। সেই রেলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্টেশন শিয়ালদা, হাওড়াকে সড়কপথে সংযুক্ত করে রেখেছে হ্যারিসন রোড। এই হ্যারিসন রোডের পূর্বের নাম ছিল সেন্ট্রাল রোড। এই রাস্তার উপরের অবস্থিত আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুরের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।
আজও এই রাস্তায় লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সহাবস্থান। বাংলার অন্যতম সেরা বাজার বড়বাজার হ্যারিসন রোডেই অবস্থিত। একদিকে যেমন এই রাস্তায় অজস্র কাপড়, কাগজ, মশলা ও নানা বিধ জিনিসের দোকান রয়েছে, তেমনই রয়েছে বর্ণপরিচয় মার্কেট। খানিক এগিয়েই আমাদের ঐতিহ্যের বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট, কফিহাউস। কলকাতার অন্যতম দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবাসী কলেজ ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এখানেই অবস্থিত। কাছেই প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্কোয়্যার। কলকাতার শিক্ষা ও ব্যবসায়িক রাজধানী বলা যায় এই চত্বরকে। এককালে গোটা হ্যারিসন রোডের শোভা ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য, রাস্তার দু-ধারে প্রায় অধিকাংশ অংশেই বাঙালি ব্যবসায়ীদের দাপট চলত। বাঙালির ব্যবসার সে সুদিন আর নেই।
কিন্তু যার নামে এই রাস্তা, তিনি কে? কে এই হ্যারিসন? স্যার হেনরি লেল্যান্ড হ্যারিসন ছিলেন একজন আই.সি.এস। ওয়েস্টমিনিস্টার এবং অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তিনি সিভিল সার্ভেন্ট হন। ১৮৬০ সালে তাঁকে বাংলায় পাঠিয়ে দেওয়া।
১৮৬৭ সালে তদানিন্তন বেঙ্গল গভর্মেন্টের জুনিয়র সেক্রেটারি দায়িত্ব পদে আসীন হন হ্যারিসন সাহেব। ১৮৭৮ সালে তিনি বোর্ড অব রেভিউনের সেক্রেটারি পদে বসেন। ঐ সময় কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার, তিলোত্তমার এই দুটি পদ একই ব্যক্তি অলঙ্কৃত করতেন। হ্যারিসন এই দুটি পদই পেয়েছিলেন। এই পদ প্রাপ্তির পরেই তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন ব্রিটিশ রাজপরিবার। বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি ও বোর্ড অব রেভিনিউয়ের সদস্যও হয়েছিলেন তিনি।
কলকাতার মাঠে ময়দানে এবং পার্কে, সভা করার ক্ষেত্রে হ্যারিসনই প্রথম অনুমতি নেওয়ার রীতিটি প্রচলন করেন। কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হয়েই, সেন্ট্রাল রোডের নাম তিনি নিজের নামে পরিবর্তন করে, হ্যারিসন রোড রাখেন। ১৮৯২ সালের ৫ই মে চট্টগ্রামে কলেরা আক্রান্ত হয়ে হ্যারিসনে মৃত্যু হয়।
এই রাস্তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানান ঐতিহ্য। এই রাস্তার উপরেই অবস্থিত ছিল সেকালের অ্যালফ্রেড থিয়েটার। সেখানেই শিশির কুমার ভাদুড়ী প্রথম 'বসন্ত উৎসব' নাটকে অভিনয় করেন।
গত শতকে এই রাস্তায় হওয়া দুটি শোভাযাত্রা আজও কলকাতার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। প্রথমটি দেশবন্ধুর শবযাত্রা। দার্জিলিং থেকে দেশবন্ধুর শবদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল শিয়ালদায়, এই রাস্তাতেই চিত্তরঞ্জন দাসের অন্তিমযাত্রা হয়। সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা হ্যারিসন রোড।
আরেক দিনও পুরো কলকাতা ভেঙে পড়েছিল হ্যারিসন রোডে, সেদিন ছিল মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের শোভাযাত্রা। ঘোড়ায় চড়ে সেই শোভাযাত্রার পুরো ভাগে ছিলেন দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু। আজও মিছিল-স্লোগানে, হাটে-বাজারের হাঁক-ডাকে কলরব মুখরিত থাকে হ্যারিসন রোড।