“ বল বীর –বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর"....
লাইনগুলো শুনলে মনে হয় কেউ যেন কোনও তীব্র কণ্ঠ রণ হুঙ্কার দিচ্ছে। তীব্র গরজনে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে পায়ের তলার মাটি। শব্দে শব্দে আগুনে দমক। রাগ, হতাশা, যন্ত্রণাগুলো - যারা এতদিন পাথর হয়েছিল, একধাক্কায় চুরমার। দ্বিধা থরথর দৃষ্টিতে যে কথাগুলোকে রোজ দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা তারা আজ বিস্ফোরণে ফেটে পড়েছে।
সব কণ্ঠের ঢেউ স্তব্ধ হয়ে আসে এই গর্জনের কাছে। এক কবির কলমের কাছে আনত হয়।
তিনি বিদ্রোহী কবি। কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজি ১৯২১ এবং বাংলা ১৩২৮ সালের কার্তিক সংখ্যায় মোসলেম ভারত পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম মুদ্রিত হয়। দুমাস পর ‘বিজলী’ এবং তিন মাস পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবিতাটি সংকলিত হয়। সেই সময়ের অস্থিরতা, উত্তাপ ও অসহিষ্ণুতা উত্তাল সময়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল কবিতাটি।
১৮৯৯। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাপটে বিশ্বজুড়ে টালমাটাল অবস্থা। ঔপনিবেশিক ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি পৃথিবী জুড়ে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। ওই বছরেই ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া অজপাড়াগাঁয়ে দরিদ্র তথাপি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিল এক শিশু। দুখু মিয়া। পুরো নাম কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ (২৪মে ১৮৯৯), মৃত্যু ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ আগষ্ট ১৯৭৬)।
ভরা গ্রীষ্মের জন্মমাস আর উথালপাথাল সময়ের জন্মসাল এই দুই-ই হয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছিল তাঁর আজীবনের নিয়তি।
বারবার তিনি ইংরেজ শাসকের রোষানলে পড়েছেন।
সমকালীন সাহিত্যিক দের মধ্যে নজরুলের বই সর্বাধিক বাজেয়াপ্ত করা হয়। কবির মোট ১২টি গ্রন্থের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছিল সরকার। এ ছাড়া ছিল ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’ দুটি পত্রিকা। তবে চূড়ান্তভাবে ৬টি বই বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ হয় এবং বাকি ৬টি বই আদেশ জারির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ না করলেও পুলিশ বইগুলোর কপি বাজেয়াপ্ত করে। নানা রকম হয়রানিতে জেরবার করার ব্যবস্থা।
পুলিশ পত্রিকা দুটিকে তিন বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে জামানত বাজেয়াপ্তির মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়। এর জন্য কবিকে দুই বার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তারমধ্যে প্রথমবার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার জন্য প্রায় তিনি বছরাধিক কাল কারাগার ভোগ করেন।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ ধূমকেতুর ১২ নং সংখ্যায় নজরুল রচিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি রাজরোষে পড়েন। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২৪ এ ধারা অনুসারে পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট নিয়ে যুগপৎ ‘ধূমকেতু’ কার্যালয় ও প্রেসে তল্লাশি চালায়। নজরুলের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে পুলিশ। ধূমকেতুর মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফ্জালুল হক সাহেব গ্রেফতার হন। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা শহর থেকে কবি গ্রেফতার হন।
নজরুলের পক্ষ সমর্থনে বেশ কয়েকজন আইনজীবি বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে এসেছিলেন। বিচারের সময় নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে যে বিবৃতি দেন, তা বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে পরিচিত। অনবদ্য ভাষায় রচিত এ জবানবন্দিটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল হয়ে আছে।
প্রথমে প্রেসিডেন্সি ও পরে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। পরে হুগলী জেল। কয়েদীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেন নজরুল। অনশন ভঙ্গের পর কবিকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়। সেখানে কবি বিশেষ শ্রেণীর কয়েদীর মর্যাদা পান। বহরমপুর জেল থেকেই ১৯২৩ সালে ১৫ ডিসেম্বর নজরুল মুক্তি লাভ করেন।
নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-সময় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সদ্য রচিত ‘বসন্ত’ নাটক নজরুলকে উৎসর্গ করেন।