হাইকোর্টের বারান্দায় দিনের আলোয় অত্যাচারী পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এই নির্ভীক বিপ্লবী

১৯১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা হাইকোর্টের বারান্দায় লুকিয়ে উঠে এসেছে এক কিশোর। লক্ষ্য এক অত্যাচারী পুলিশ অফিসার। একটি বিশেষ কাজে সেই পুলিশ অফিসার আসবে এই কলকাতা হাইকোর্টে।

কলকাতা হাইকোর্টে তখন আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। এই মামলার ফলে বাংলায় চলতে থাকা গুপ্ত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। এর মূলে ছিলেন তিন রাজকর্মচারী। ইন্সপেক্টর নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, উকিল আশুতোষ বিশ্বাস এবং ডিএসপি শামসুল আলম। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নেয় এদের হত্যা করার। বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকে গ্রেফতারের প্রচেষ্টা করার জন্য নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে হত্যা করেছিলেন আরেক বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র পাল। আলিপুর বোমা মামলার পাবলিক প্রসিকিউটার আশুতোষ বিশ্বাসকে হত্যা করেছিলেন বিপ্লবী চারুচন্দ্র বসু।

বাকি ছিলেন আরেকজন। তিনি আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান তদন্তকারী আধিকারিক ছিলেন। তিনি শামসুল আলম। বিপ্লবীরা তাকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন। অনেকদিন ধরেই চলছিল পরিকল্পনা।

১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর ষড়যন্ত্র   মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। সেই রায়ে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্তসহ বহু বিপ্লবী দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাদের সাজা ঘোষণা করা হয়।

তাহলে শামসুল আলমকে শাস্তি দেবে কে? বিপ্লবী বাঘাযতীন তাঁর প্রিয় শিষ্য বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের কাঁধে এই কাজের ভার দিয়ে যান।

১৯১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, হাইকোর্টের বারান্দা। শামসুল আলম তখন মামলার জন্য হাইকোর্টে এসেছেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। আগেই তৈরি ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত। ছদ্মপরিচয়ে হাইকোর্টে ঢুকেছিলেন তিনি।

সেদিন বীরেন্দ্রনাথ লুকিয়েছিলেন একটা থামের আড়ালে। সিঁড়ি দিয়ে বুটের শব্দ তাঁর ভেতরে দামামা বাজাচ্ছে। আর একটু পরেই সে পৌঁছে যেতে পারবে তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে। এইতো! সাংঘাতিক অত্যাচারী, খুনী লোকটা একেবারে সামনে চলে এসেছে বীরেন্দ্র দত্তগুপ্তের। পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জে গুলি করেন বীরেন্দ্র। অনবরত গুলি করতে করতে তিনি আদালত চত্বর থেকে পালাতে চেষ্টা করেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রিভলভারের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর আদালতের রক্ষীরা তাঁকে ধরে ফেলে।

এরপর বীরেন্দ্র দত্তগুপ্তের ওপর চলতে থাকে অকথ্য অত্যাচার।  পুলিশের কাছে তিনি কিছুতেই গোপন তথ্য ফাঁস করবেন না। পুলিশের  সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে থাকেন। ভারতের এমনই বীর সন্তান ছিলেন বীরেন্দ্র নাথ দত্তগুপ্ত ।

১৮৮৯ সালের ২০ জুন ঢাকা বিক্রমপুরের বালিগাঁও গ্রামে জন্ম হয় বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের। বাবা উমা চরণ এবং মা বসন্তকুমারীর দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। বাবাকে হারান খুব ছোট্ট বয়সেই। ১৯০৮ সালে বীরেন্দ্র জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে কলকাতায় আসেন।

এখানেই দেখা হয় কানাইলাল দত্তের সঙ্গে। কানাইলাল দত্ত তাঁকে বিপ্লবের সঙ্গে পরিচয় করান। ব্রিটিশ শৃংখল থেকে ভারতের মুক্তি যে কতটা প্রয়োজন ছিল তা তিনি বীরেন্দ্রকে বোঝান। কানাইলাল দত্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সক্রিয় বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত। তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ বাঘাযতীনের শিষ্য  হিসেবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।

শামসুল আলমকে হত্যা করার অপরাধে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করলেও কিছুতেই বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। পুলিশি জেরা চলাকালীন তিনি কোন গোপন তথ্য ফাঁস করেননি। এমনকি হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোন উকিলের সাহায্য নিতেও তিনি অস্বীকার করেন। বিচারপতি লরেন্স জেনকিন্স ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে আসামীপক্ষের উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু তারপরেও একটি কথাও বের করতে পারেননি উকিল। অবশেষে নিশীথ সেন বীরেন্দ্রনাথকে বিকৃত মস্তিষ্ক আখ্যা দেন। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়।

শামসুল আলম হত্যার কিছুদিন পরেই কলকাতা হাইকোর্টে হাওড়া শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। বাঘাযতীন সহ ৪৭ জন গ্রেফতার হন। কিন্তু এই অভিযোগের প্রমাণ কোথায়? পুলিশ বুঝতে পারছিল এভাবে কোন কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। খুব তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করা বিপ্লবীদের হয়তো ছেড়ে দিতে হবে। এদিকে বীরেন্দ্র পুলিশের একটি প্রশ্নের উত্তর দেননি। সরকার একটা জঘন্য চক্রান্তের পরিকল্পনা করে তখন।

বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের হাতে তুলে দেয় ওদেরই বিপ্লবী দলের একটা গোপন ইশতেহারের মতোই একটি কাগজ। যেটি আদতে সেই বিপ্লবী দলের নয়। বাঘা যতীনের নকল সই সম্বলিত একটি নিবন্ধে শামসুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে পুলিশের পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করা হয় ওই মিথ্যে কাগজে। কাগজটিতে লেখা ছিল শামসুল আলমকে বীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুপ্ত নয় সতীশ সরকার নামে অন্য একজন হত্যা করেছেন। বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত নাকি পুলিশের চর এমনটাই উল্লেখ করা ছিল কাগজে।

আবেগপ্রবণ বীরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন যতীন্দ্রনাথ অর্থাৎ বাঘাযতীন তাঁকে দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করার জন্য এমন চক্রান্ত করেছেন। এই কলঙ্কমোচনের জন্য বীরেন্দ্রনাথ মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং ফাঁসির আগে তিনি তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানান যে তিনি যতীন্দ্রনাথের নির্দেশে শামসুলকে হত্যা করেছেন। বীরেন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তি বাংলার বিপ্লবকে গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল।

তবে এই সমস্যা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের ফাঁসি হয়। তারপর শুধুমাত্র বীরেন্দ্র নাথ দত্তগুপ্তের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সকল বিপ্লবীদের শাস্তি দিতে পারেনি সরকার। তাই এই সকল বিপ্লবীরা অবশেষে এই মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তবে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত বাংলার বিপ্লবের ইতিহাসে এক অন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...