তিন টাকা দামের সাদামাটা বই তোলপাড় করেছিল দেশ

পিচবোর্ডের মলাট। সাদা কাগজে মোড়া। ওপরের দিকে লাল রঙে লেখা বইয়ের নাম। পথের দাবী। বইয়ের পাতার গন্ধের থেকেও বেশি এই বইয়ে লেগেছিল বিপ্লবের গন্ধ। সংগ্রামের সুবাস ছড়িয়েছিল এই বই। লড়াইয়ের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছিল এই বই। 'পথের দাবী'। পথের দাবীর পথচলা সহজ ছিল না একেবারেই।

সাদামাটা দেখতে এই বইটা তোলপাড় করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের অন্দরমহল। কিন্তু এই বইয়ের জন্মের শুরুটা ছিল একেবারে অন্যরকম। স্বয়ং লেখক এই বই প্রকাশ করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। সে সময় উত্তাল ছিল বাংলা। দিকে দিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছে। এক প্রতিবাদী ধরনের উপন্যাস লিখলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

এ লেখা যেন আত্মকথন। পথের দাবীর সব্যসাচী চরিত্র বিপ্লবের সমার্থক হয়ে উঠেছিল সেই সময়। লেখক তো লিখে রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে। ইংরেজদের অত্যাচার আর বাংলার মানুষের লড়াই-এর প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই লেখা হয়েছিল এই উপন্যাস। প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল না কথাসাহিত্যিকের। আসলে ব্রিটিশ সরকারের সময়ে এই উপন্যাস যে প্রকাশ করা যাবে তাও ভাবেননি কথাসাহিত্যিক।

গল্পচ্ছলেই বলা যেতে পারে বা নেহাত কাকতালীয়ভাবেই বঙ্গবাসী পত্রিকার মালিককে তিনি দেখান তাঁর এই উপন্যাস। উপন্যাস দেখেই পত্রিকার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এই উপন্যাস ছাপা হবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও রাজি করালেন পত্রিকার সম্পাদক। ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিন মাস সময় ধরে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি।

যত সময় এগিয়েছে এই উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। সব্যসাচী হয়ে ওঠে মানুষের কল্পনার নায়ক। এমন এক নায়ক যাঁর প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল বাংলার লড়াকু বিপ্লবীরা।

১৯২৬ সালের মাঝামাঝি বই হয়ে বেরোয় এই উপন্যাস। মানুষের মনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় খুব কম সময়ে। ব্রিটিশরা প্রমাদ গোনে।

ব্রিটিশরা রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল এই উপন্যাসকে নিষিদ্ধ করতে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। মৃদু আপত্তি শোনা গিয়েছিল বাংলার অস্থায়ী মুখ্য সচিব প্রেন্টিস   সাহেবের গলায়। কিন্তু ট্রেগার্ট ছিলেন নিজের ভাবনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বিপ্লবীদের মনোবল ভেঙে দিতে তিনি ছিলেন মরিয়া।

বইতে বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে, ইংরেজবিরোধী বার্তা প্রচার করা হয়েছে এই অভিযোগে ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এই বইকে। কিছু ঐতিহাসিক বলেন ওই বছর পয়লা জানুয়ারি অর্থাৎ বছরের প্রথম দিনেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল এই বইকে। কিন্তু মতান্তরে তারিখটি ছিল চৌঠা জানুয়ারি। কিন্তু ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম সংস্করণের তিনহাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ সরকারের এমন স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ভেবেছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাশে চেয়েছিলেন। চিঠি আদান-প্রদান হয়েছিল।কিন্তু সফল হননি। কবিগুরুকে পাশে পাননি তিনি।কিছু চিঠি লিখে রেখেও কবিগুরুকে আর পাঠাননি স্বয়ং কথাসাহিত্যিক।

শেষ লেখা কথাসাহিত্যিকের চিঠিটি কবিগুরুকে আর পাঠাননি তিনি। এই চিঠিতে নিজের অভিমান ব্যক্ত করেছিলেন কথাসাহিত্যিক।

উমা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বঙ্গবাসী মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস। কবিগুরুকে এই উপন্যাস পড়ার অনুরোধ করেছিলেন স্বয়ং লেখক। কবিগুরু বইটি পড়ে কথাসাহিত্যিককে জানিয়েছিলেন যে তিনি এই বই নিষিদ্ধ করার দাবির বিপক্ষে কথা বলতে পারবেন না। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন " আপনি লিখেছেন ইংরেজরাজের প্রতি পাঠকের মন এই বই পড়ে অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। ওঠবারই কথা। কিন্তু কোন অসত্য কথা প্রচারের মধ্যে দিয়ে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আমার লজ্জাই করত। কিন্তু জ্ঞানত আমি তা করিনি। নানা কারণে বাংলা ভাষায় এই ধরনের বই কেউ লেখে না। আমি যখন লিখি এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল জেনেই লিখেছিলাম। সামান্য সামান্য অজুহাতে ভারতের সর্বত্রই যখন অবিচারে অথবা বিচারের ভান করে কয়েদ, নির্বাসন প্রভৃতি লেগেই আছে তখন আমি যে নিষ্কৃতি পাবো অর্থাৎ রাজপুরুষেরা আমাকে ক্ষমা করবেন এই দুরাশা আমার নেই।"

পথের দাবী নিয়ে এই অভিমান লেখককে সঙ্গ দিয়েছেন সারা জীবন। রাধারানী দেবীকেও তিনি অভিমানভরে জানিয়েছিলেন এই দুঃখের কথা।

এই লড়াই ছাড়াও এই বইয়ের ভাগ্যে জুটে ছিল প্রশংসাও।

তবে বাংলা সরকারের ইয়ার বুকে পথের দাবী সম্পর্কে লেখা হয়েছিল "দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল প্রিচিং অফ সিডিশন ইন অলমোস্ট এভরি পেজ অফ দ্য বুক।"

এই বই প্রচার বন্ধের জন্য ডাক বিভাগ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। তারা একটি বিশেষ নোটিফিকেশন জারি করেছিল। তাতে লেখা হয়েছিল “ইন্ডিয়ান পোস্ট অফিস আইনের ২৭-বি ধারায় আপনাদের জানানো হচ্ছে ডাকবন্টনের সময় যদি কোন প্যাকেটে শরৎচন্দ্রের পথের দাবী পাওয়া যায় তবে তা আটক করবেন। এই আটক করা বইটি কলকাতার ডিআইজি পুলিশকে পাঠাতে হবে।”

এভাবেই কাগজে মোড়া এই বিপ্লবের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। তবে পথের দাবীকে রাহু মুক্ত করার একটি চেষ্টা করা হয়েছিল তার লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানে। ১৯৩৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি অ্যালবার্ট হলে শরৎচন্দ্রের প্রথম স্মৃতি-বার্ষিক অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার সভাপতি রূপে অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রস্তাব করেন "শরৎচন্দ্রের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার নাগরিকদের এই সভা বাংলা সরকারকে পথের দাবী উপন্যাসের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছে।"

এভাবেই সংগ্রামের পথে চলে এই সাহিত্য আজ কালজয়ী। আমাদের সমাজের পথপ্রদর্শক। ইতিহাসের বার্তা হয়ে বেঁচে রয়েছে এই সাহিত্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...