১৯২৮ সাল। তখন সাইমন কমিশন ভারতে এসেছে। সাইমন কমিশনকে নিয়ে বিদ্রোহের রেশ চলেছিল অনেকদিন। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিদ্রোহের আয়োজন করেছিলেন লালা লাজপত রাই। একটি মিছিলের একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশরাও এই গণ আন্দোলন দেখে যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিল।
লালা লাজপত রাইয়ের এই মিছিলের কথা আগে থেকেই জানতে পারে ব্রিটিশরা। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের ওপর চড়াও হয় পুলিশ বাহিনী। এলোপাথাড়ি লাঠি বর্ষণ করতে থাকে পুলিশরা।
বৃদ্ধ লালা লাজপত রাই সেই আঘাত নিতে পারেননি। পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন, পরে মারা যান তিনি। পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের কাছে রীতিমত বটগাছের ছায়ার মতো ছিলেন লালা লাজপত রাই। এই নেতার মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কেউ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ব্রিটিশ সাহেবদের সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার মত কোন পরিকল্পনা করতে হবে।
এই সময়েই ব্রিটিশরা সারা ভারতবর্ষে অকথ্য অত্যাচার চালাতে শুরু করেন। বাংলাতেও তখন নানা জায়গায় বিপ্লবীদের ধরে গ্রেফতার করছিলেন ব্রিটিশরা।
বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত এই সময়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বর্ধমানে। তিনি এক প্রতিবেশীর বাড়ির নীচে একটি গোপন সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করেছিলেন।
এদিকে তখন লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে পঞ্জাবের বিপ্লবীরা। ব্রিটিশরা তাই পঞ্জাবে বিপ্লবীদের অকারণে গ্রেফতার করা শুরু করেছিলেন। ভগৎ সিং-এর ওপর ব্রিটিশদের নজর ছিল অনেকদিন থেকে। তাই ভগৎ সিং-এর আত্মগোপন করাটা জরুরী হয়ে পড়ে। শোনা যায় এই সময় ভগৎ সিং বাংলায় চলে এসেছিলেন। আত্মগোপন করে থাকার সময়ই দেখা হয়েছিল বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের।
দুই সাহসী মানুষের দেখা। অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় এই দুই বিপ্লবীর। পরিকল্পনা চলে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার।
এদিকে সেই সময় ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনা করে পাবলিক সেফটি ও ট্রেড ডিস্পিউট বিল পাস করার। বিল অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে কোন কারণ ছাড়াই সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এমনকি প্রকাশ্যে কোন প্রতিবাদ করা যাবে না কোন আন্দোলনকারীদের। বিপ্লবীরা বুঝতে পারে যে, এভাবেই বিপ্লব আটকাতে চাইছে ব্রিটিশ সরকার।
ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন এই সময়ে।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল। এই দিনই দিল্লির পার্লামেন্ট হাউসের পাবলিক সেফটি ও ট্রেড ডিস্পিউট বিল পাস হওয়ার কথা। কিন্তু আগে থেকেই ছদ্মবেশে সংসদ কক্ষে দুজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। পরিচয় গোপন করে ঢুকেছিলেন তাঁরা। দর্শকাসনে চুপচাপ বসেছিলেন। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। হাতে ছিল তাজা দুটো বোমা।
বিল পাস হওয়ার মুহূর্ত চলে এসেছে। এই সময় অনেক বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল ঘর। সংসদ কক্ষ জুড়ে শুধুই ধোঁয়া। কয়েকজন আহত হলেন। সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে গর্জে উঠেছিল দুটো আওয়াজ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ছদ্মবেশ ভেদ করে স্পষ্ট তখন দুটো মুখ। ভয়হীন, কঠিন, বিদ্রোহী মুখ। ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত। ক্রমশ গর্জে উঠেছিল তাঁদের গলা। এক সময় এগিয়ে এলো সশস্ত্র পুলিশ। গ্রেফতার করা হলো দুজনকে।
বিচারে ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়। কিন্তু বটুকেশ্বর দত্তের বিরুদ্ধে তেমন প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি পুলিশ। তাই তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।
দীর্ঘদিন জেলেবন্দী জীবন কাটিয়ে অবশেষে ছাড়া পেয়েছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। কিন্তু শেষ জীবনটা চরম অর্থকষ্টে কেটেছিল তাঁর। নিজের চিকিৎসা করানোর টাকাও ছিল না।
তবুও সেদিনের সেই দুই সাহসী বিপ্লবীর আত্মঘাতী পরিকল্পনা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল।