দীপান্বিতা অমাবস্যা আসন্ন, কালী আরাধনায় মাতবে বঙ্গদেশ। কালী ছিলেন মৃত্যুর দেবী, আজ শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠেছেন বাংলার ঘরের দেবী; যার নেপথ্যে ছিলেন এক তান্ত্রিক। পঞ্চদশ শতকে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বাংলায় প্রথম কালী পুজোর প্রচলন করেন। তন্ত্র মতেই শুরু হয়েছিল বাংলার প্রথম কালী পুজো। সে থেকেই কালীর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে তন্ত্র। তন্ত্র বিদ্যা চর্চার আদত উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা, শক্তি লাভ। শাক্তদের দেশ বঙ্গে শক্তির আধার হলেন দেবী কালিকা। তন্ত্রমতে দেবী কালিকাই কমলা, মহালক্ষ্মী, তিনিই তন্ত্রের দেবী মাতঙ্গী বিদ্যাদাত্রী সরস্বতী।
‘তনু’ থেকে ‘তন্ত্র’ কথাটি এসেছে। ‘পঞ্চ ম’-এর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তন্ত্র সাধনা। তন্ত্র মতানুযায়ী, কালীপুজোর মূল উপকরণ হল এই পঞ্চ ম। তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্রে ‘পঞ্চ ম’-র ব্যবহার হয়। ‘পঞ্চ ম’ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। একটি মতে, ‘পঞ্চ ম’ হল মদ্য অর্থাৎ মদ, মাংস, মৎস্য অর্থাৎ মাছ, মুদ্রা অর্থাৎ অঙ্গভঙ্গী, মৈথুন অর্থাৎ রতী। পঞ্চমকার দেবীকে নিবেদনে সিদ্ধিলাভ সম্ভব। বাম-হস্ত পথ অর্থাৎ বামাচারী তান্ত্রিকরাই পঞ্চমকার পদ্ধতি অনুসরণ করেন। দক্ষিণ-হস্ত পথ বা দক্ষিণাচারী তান্ত্রিকরা এই মতের বিরোধী। তামসিক অর্থাৎ পশ্বাচার, রাজসিক অর্থাৎ বীরাচার বা দিব্যাচার অর্থাৎ সাত্ত্বিক সাধনার অংশ রূপে পাঁচ উপাদানের ফারাক রয়েছে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে সাধক, ভক্তরা সিদ্ধিলাভের জন্য তন্ত্র সাধনা করে আসছেন। তন্ত্র সাধনা গুপ্ত। তন্ত্র সাধনা খুবই কষ্টকর, পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বশে এনে সাধককে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগাতে হয়। কাপালিক, অঘোরী, তান্ত্রিকরা তন্ত্রের দ্বারা কালী সাধনা করেন। নিষ্ঠাভরে তন্ত্র সাধনা করতে হয়। দোষ, ত্রুটি হলেই সাধকের সর্বনাশ হতে পারে। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মা কালীর পুজোয় বলিদান করা হয়। বলির মাংস ভোগ নিবেদন করা হয়। পাঁঠার ঘাড় বা গলার কাছ থেকে কয়েক টুকরো মাংস ও রক্ত নিয়ে ছোট মাটির সরায় করে নিবেদন করা হয়। একটি করে কলা দিয়ে মা কালীকে নিবেদন করা হয়। বলির মাংস রান্না করে মায়ের ভোগে দেওয়া হয়। মাকে কারনবারি নিবেদন করা হয়। তন্ত্র মতে, কালীপুজোয় বোয়াল মাছ এবং অন্যান্য মাছ ভোগ দেওয়া হয়।
প্রথম শতকের প্রথমভাগে তন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। দশ মহাবিদ্যার ওপর নির্ভর করেই তন্ত্র গড়ে উঠেছে। এই দশ মহাবিদ্যার প্রথম বিদ্যা হলেন মা কালী। গুপ্ত যুগের শেষ দিকে তন্ত্রের প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছিল। চৈনিক পরিব্রাজকরা অনেক তন্ত্রের পুঁথি তাঁদের দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে বৌদ্ধধর্মে তন্ত্রের প্রবেশ ঘটে, আরও উন্নত হয় তন্ত্র, নয়া রূপে তা আর্যাবর্তে ফিরে আসে। অবিদ্যাকে জয় করে জ্ঞানশক্তির উন্মোচন করে তন্ত্র। মুক্ত বিশ্বকোষে বলছে, মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনঃজন্মের হাত থেকে মুক্ত করাই হল তন্ত্রের লক্ষ্য।
কালীক্ষেত্র বীরভূম হল তন্ত্রের সিদ্ধপীঠ। কঙ্কালীতলা, নলাটেশ্বরী, নন্দীকেশ্বরী, বক্রেশ্বর এবং ফুল্লরা; সতীর একান্ন পীঠের পাঁচটি পীঠ রয়েছে বীরভূমে। বাংলার বীরভূম হল তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীনকালে বীরভূম ছিল সাধক, মুনিদের বিচরণ ক্ষেত্র। বিভাণ্ডক, ঋষ্যশৃঙ্গ, সন্দীপন, গর্গ, দুর্বাসা, মাণ্ডব্য, বশিষ্ঠ কার আশ্রম ছিল না বীরভূমে? এই বীরভূমই হল বাংলার শ্রেষ্ঠ তন্ত্রপীঠ।
তন্ত্রের আচারে মিশে রয়েছে নানান অদ্ভুত বিষয়, গভীর রাতের শ্মশানে শিবাভোগ, শব সাধনা, প্রেত চর্চা। আপাতভাবে আড়ালে, আবডালে চলে তন্ত্র সাধনা। লোকচক্ষুর আড়ালে এই সাধনা আরও বেশি করে মানুষের কৌতূহল বাড়িয়েছে। অঘোরীরা মেতে ওঠেন শব সাধনায়। অমাবস্যার অমানিশা ভরা রাতে শুরু হয় শক্তির উপাসনা। তন্ত্রকে ঘিরে আজ বাসা বেঁধেছে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। আদপে তন্ত্র একটি সাধন পদ্ধতি। যার লিপি রয়েছে, রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য, ইতিহাস। এই সাধনার উদ্দেশ্যেও মোক্ষলাভ কিন্তু সাধনপথটি ভয়ঙ্কর, গুপ্ত, চিরাচরিত নয়। সেই কারণেই তন্ত্রকে ঘিরে আঁধার জাঁকিয়ে বসেছে। জিয়ো বাংলা কোনও অতিপ্রাকৃতিক জিনিসে বিশ্বাস করে না। কালী ক্ষেত্র বঙ্গদেশের তন্ত্র ও কালী পুজোর ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরতেই এই প্রতিবেদন।