ডেড সি থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দক্ষিণ জর্ডানের এই শহর নাবাতিনিয়দের (আরব গোষ্ঠীর) রাজধানী ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ -১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
অতি আশ্চর্যের বিষয় হলো এই পুরো শহরটি কিন্তু গুহার মধ্যেই অবস্থিত এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী। রুকমুর অধিবাসীর কাছে এই শহর পেত্রা নামে পরিচিত এবং এই নামেই আমরা এখনও জানি। পেত্রার ল্যাটিন অর্থ পাথর। সেদিক থেকে নামকরণ সার্থক। পেত্রা, তার স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য বিখ্যাত।
(প্রবেশ পথ থেকে খানজেট)
সবচেয়ে বিখ্যাত – প্রবেশপথ, যা সিক নামে পরিচিত। দুটো পাহাড়ের মধ্যেই দিয়ে অতি সংকীর্ণ প্রায় ৩ মিটারের মতো এই পথ। এই সিক বা প্রবেশপথের সামনে থেকে যা চোখে পড়ে তা হলো অন্যতম আকর্ষণ খাজনেট ফিরাউন, কথিত আছে যে এটা নাবাতিনিয়দের ও পরে মিশরের ফারাওদের ধনভান্ডার ছিল।
(প্রবেশপথ সিক)
(খানজেট ফারাউন)
উনিশ শতকের সূচনাতে বেদুইনরা এই ভান্ডার লুটের চেষ্টা করে যার প্রমান ক্ষত হয়ে আছে। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে একমাত্র এই কাঠামোটি অক্ষত আছে। এর গাত্রে গ্র্রিক মিথোলজির নানা গল্প চিত্রিত আছে। একেবারে উঁচুর দিকে ৪টি ঈগল আত্মার বাহক হিসেবে চিত্রিত। তার নিচে কুঠারহাটে নৃত্যরত আমাজন (গ্রিকদের যুদ্ধরত রমণী) চিত্রিত এবং প্রবেশপথে গ্রিক মিথোলজির অন্যতম চরিত্র ক্যাস্টর ও পল্লুক্স (অলিম্পাস পাহাড়ের বাসিন্দা) স্বাগত জানাচ্ছে।
খাজনিত ফিরাউন মন্দির নাবাতিনিয়ো রাজা চতুর্থ আরেটাস সমৃদ্ধির স্মারক প্রদর্শণে নির্মাণ করেন। অন্য আকর্ষণ ওয়াদি মুসা ব্রিজটি ও তার গাত্রে রুকমু লেখটি সাক্ষ্য বহন করছে। অর্ধগোলাকৃতির নাট্যশালার নিদর্শন আছে, যেখানে ৩৫০০ দর্শক বসতে পারত। আল -দেয়ার (আবেদাসের আরাধণায় যে বিশাল মন্দির দেখা যায়)তার গাত্রে কিছু লিপির পাঠোদ্ধার হয়েছে। আরো তাৎপর্য পূর্ণ হলো পেত্রার একোয়াডর্ট পদ্ধতি।
(ওয়াদি মুসা ব্রিজ)
(থিয়েটার হল)
পাথুরে শহর হওয়ায় গুহাগাত্রে ও স্থলভাগে খোদাইকৃত চ্যানেলগুলো সিরামিক পাইপ দিয়ে নির্মিত হতো। যার প্রত্নতাত্বিক অবশেষে প্রাপ্ত হয়েছে। তাই রাশ শহরও বলা হয়, সুতরাং কৃষ্টিমূলক কাজে তার সমৃদ্ধি স্থাপত্য পরিচয়বাহী। এর কারণ হিসেবে বলা যায় পেত্রা-র অবস্থান ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য। চারদিকে উঁচু পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত এই শহর পারস্য উপসাগরীয় বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করতো রোমানদের বাণিজ্যিক উত্থানের আগে।
(আল দিয়ার)
(পুরোনো মন্দির)
১০৬ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা এটি দখল করলে পেত্রা তার স্বাধীনতা হারায় এবং নতুন নাম হয় 'আরব পেত্রায়া' ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভাটা পড়ে। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দে চরম ভূমিকম্পে এই শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তার গরিমা হারায়। ৭ম শতকে মুসলিমদের দখলে গেলেও ১২শ শতকে তা ক্রুসেডারদের হাত বদল হয়। যদিও তা দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত এবং বেদুইন গোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল।
১৮১২ সালে বারখার্ড, সুইস পর্যটক এই শহর পুনরাবিষ্কার করে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন এবং লাল পাথর-এর এই শহর তিনি 'লাল গোলাপের শহর’ নামে চিহ্নিত করেন। ১৯৮৫ ইউনেস্কো, শহরটিকে হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষণা করে। প্রত্নতত্ববিদ ফিলিপ হ্যামন্ড দীর্ঘ ৪০ বছর পেত্রা পরিদর্শন করে ১৯৯৩ তে উইংডড সিংহ মন্দিরের কাছাকাছি বাইজান্টাইন যুগের স্ক্রল আবিষ্কার করেন। ২০০৭ সালে সপ্তম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এই পেত্রা। ২০১৬ সালে উপগ্রহ চিত্রাবলীর মাধ্যমে বিশাল কবরস্থানের সন্ধান পাওয়া গেছে এই জায়গায়। যার খনন কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় বাইবেল এ বর্ণিত এই লাল গোলাপের শহরের আরো ঐতিহ্যশালী ইতিহাস আছে যা ইতিহাসের ভান্ডারকে আরো ঋদ্ধ করবে। তবে পর্যটকদের কাছে আজ অত্যন্ত জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু এই শহর, তা অনস্বীকার্য।