উদ্ধার হতে চলেছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ 'ধূমকেতু' মামলার নথি। এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন কলকাতা নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলাল।
গতকালই ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। বিদ্রোহী কবি হিসেবেই তিনি সকলের কাছে বেশি পরিচিত। জীবনের শুরুতে যদিও তিনি মিলিটারিতে ছিলেন, তবু ইংরেজ শাসকের অত্যাচার তাঁকে পীড়িত করত শুরু থেকেই। পরবর্তীতে সেই পীড়ন ধরা পড়েছে একের পর এক তাঁর লেখনীতে। বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে। লাগামছাড়া ভাষায় তার প্রকাশ ঘটত। জেলবন্দীও হয়েছেন বেশ কয়েকবার, তা আমাদের সকলেরই জানা। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন কারনে বার বার শিরোনামে এসেছেন তিনি। বাংলা ভাষার প্রথম অসাম্প্রদায়িক কবি ছিলেন তিনি। জন্মসূত্রে ভারতীয় ঐতিহ্য গ্রহণ করেছিলেন এবং ধৰ্মসূত্রে পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অর্জন করেছিলেন নজরুল। দ্বিমাত্রিক ঐতিহ্য রোধে ঋদ্ধ ছিল নজরুলের সৃষ্টিশীল মানস। ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেননি কখনোই। তাঁর বিদ্রোহ ছিল ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
নজরুল অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু চালু করেন। ১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় তাঁরই কবিতা 'ধূমকেতু' প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় পত্রিকাটির বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। 'মোহররম সংখ্যা', 'আগমনী সংখ্যা', 'দেওয়ালি সংখ্যা', এবং 'কংগ্রেস সংখ্যা' ছিল এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর 'আনন্দময়ীর আগমনে' নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কিন্তু পত্রিকার সেই সংখ্যাটি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় ৮ নভেম্বর। সেই বছরেই তাঁর 'যুগবাণী' প্রবন্ধগ্রন্থ নিষিদ্ধ হয় ২৩ নভেম্বর এবং সেই দিনেই কুমিল্লা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। এখানে আনা হলে তাঁর বিচার হয়েছিল ব্যাংকশালের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সেই সময়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করে পাঁচ টাকা জরিমানা করেছিলেন বিচারক। কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটি প্রেসে ধূমকেতু পত্রিকাটি ছাপা হত। সিল করে দেওয়া হয় ওই প্রেসটি। মামলার তদন্ত শেষ করে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনে পুলিশ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে চার্জশিট পেশ করে। মামলাটি বিচারের জন্য যায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। সেখানে চার্জ গঠন করে কবির বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একাধিক সাক্ষী কোর্টে সাক্ষ্য দেন। পরবর্তী সময়ে দোষী সাব্যস্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও তাঁকে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। জানা গিয়েছে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই ওই মামলার যাবতীয় নথিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফৌজদারি কোর্টের রেকর্ডরুমে। সেখানেই ওই নথি রাখা আছে। আইনজীবীদের বক্তব্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বহু বিশিষ্টদের গ্রেফতার করে এই আদালতে হাজির করা হয়েছিল।
সিদ্ধার্থবাবু কিছুদিন আগেই ব্যাংকশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের(সিএমএম) কাছে চিঠি লিখে ওই নথির বিষয়ে জানতে চান। জানা গিয়েছে মুখ্য বিচারক গত সপ্তাহে দফতরের বিভিন্ন অফিসারদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথাও বলেন। এই ধরণের নথি আলমারিতে বন্ধ না রেখে সর্বসমক্ষে আসাটা একান্ত জরুরি বলেই জানান তিনি আধিকারিকদের। সাধারণ মানুষ যেমন কাছ থেকে এই অমূল্য নথি দেখবার সুযোগ পাবেন, তেমনি ওই নথি সংরক্ষণের ফলে সেটি দীর্ঘ সময় বাঁচিয়ে রাখাও সম্ভব হবে। জানা গিয়েছে, ওই নথি পাওয়া গেলে তার প্রতিটি পাতাই মাইক্রো ফিল্ম করা হবে। দেরিতে হলেও যদি ধূমকেতু পত্রিকা সংক্রান্ত মামলার নথি সর্বসমক্ষে আনা হয়, সেটি অবশ্যই আনন্দের বিষয় হবে।