এক শ্রমজীবী লেখোয়াড়
দেশের স্বাধীনতা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল তাঁর শৈশবের কাঁচা দেওয়ালে।
বছর তিনেকের কচি নরম আঙুলে বাবার বুক জড়িয়ে পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে এই বঙ্গে ঠাঁই।সঙ্গে মা ও দিদি। দেশ তখন স্বাধীনতার স্বাদে উত্তাল। উঠলেন বাঁকুড়ার রিফিউজি ক্যাম্পে। চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মরিচীকা।
খালি পেটে থাকতে থাকতে একসময় শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখেছেন নিজের দিদিকে। দণ্ডকারণ্যের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে নারাজ বাবা। নাম কাটা গেল রিফিউজি ক্যাম্প থেকে। যাযাবরের জীবন হল নতুন পরিচয়।
বাবার শরীরে ভাঙন তাঁকে এনে দাঁড় করালো জীবন সংগ্রামের কাঠগড়ায়। বই পড়ার ইচ্ছে থাকলেও, নেই উপায়। নরম হাত শক্ত হতে শুরু করল। কখনও চায়ের দোকানের গেলাস ধুয়ে; কখনও মাঠে লাঙল টেনে। ছোট্ট কাঁধে মায়ের দায়িত্ব।
জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, গুয়াহাটি, লখনও, বেনারস। তারপর আবার ফিরেছেন কলকাতায়।যত বদলেছেন জায়গা, ততই কর্কশ হয়েছে ভিতরের শিশুটা। হোটেলে পেট পুরে খাবার খেয়ে দৌড়ে পালিয়েছেন।যেন বিভেদপূর্ণ এই সমাজকে অস্বীকার করার তীব্র আকাঙ্খা।তবুও পল্কা মেরুদণ্ডে অত জোর কই!
সেই শুরু মনে মনে বিদ্রোহ করা। অসম যা কিছু সেসবের বিরুদ্ধে।পেটের দায়ে একসময় হাতে তুলে নিলেন চাকু-বোমা। মদে ডুবে থাকলেন সারাদিন।তারপর শহরের আকাশে ঘনালো নতুন আন্দোলনের মেঘ।সেই আন্দোলন মুক্তির। মেঘ সরিয়ে নতুন সূর্য দেখার বিপ্লব। যে সূর্যের আলো সকলের শরীর ছুঁয়ে যাবে এক সরলরেখায়। থাকবেনা কোনও অর্থের নিরিখে ভেদাভেদ।
তিনিও তো এরকমই একটা সমাজের স্বপ্ন চোখে এঁকেছিলেন। শুকিয়ে যাওয়া দিদির হাত আগলে তিনিও হয়ত কোনও বিকালে গ্রামের এক মাঠের পরে ছুটে যেতে দেখেছিলেন রেলগাড়ি। গল্প এইভাবেই সত্যের হাতছানি দেয়।
জড়িয়ে পড়লেন নকশাল আন্দোলনে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নতুন ঠিকানা হল গরাদের ওপারে। বাকিটা আজ গল্পের মতই বটে!
মনোরঞ্জন ব্যাপারি। তাঁর ব্যাপার সত্যিই ভিন্ন মাত্রার। যিনি জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে নিজের ঠিকানা বদলেছেন শুধুমাত্র একটা সহজ সরল জীবন পাওয়ার আশায়। সকলেই তো তাই চায়।
সংশোধনাগারেই তিনি পেলেন নিজের ভাগ্য বদলাবার প্রথম বড় সুযোগ। এক বৃদ্ধ আসামী তাঁকে লিখতে শেখালেন।মাটি হল স্লেট। গাছের ডাল ভেঙে বানালেন কলম। রত্নাকরের বাল্মিকী হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ।
বই পড়ার অভ্যেস তাঁর বরাবরের। লিখতে না জানলেও সেটাও এখন করায়ত্ত। সংশোধনাগার থেকে বেরিয়েই হাতে তুলে নিলেন কলম।শুকনো ডালে নতুন মুকুলের গন্ধ এসে লাগল। একে একে ফুটতে থাকল ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন, অন্য ভুবন, বৃত্তের শেষ পর্ব...
জীবিকার টানে আগে থাকতেই চালাচ্ছেন রিক্স।যাদবপুর স্টেশন চত্বরে। সেই বাহনেই একদিন উঠলেন হাজার চুরাশির মা, মহাশ্বেতা দেবী। এক রিক্স চালক, জাতে পিছিয়ে পড়া- তবুও স্বপ্ন দেখেন এক নতুন সমাজের। সুযোগ এল ম্যাগাজিনে লেখার।
তখন আটের দশক।নকশালের আগুন রাজনীতির চাপানউতোরে ততদিনে ছাই হয়েছে ফুটপাথের কোনায়। কিছু রক্তের সঙ্গে ভেসে গিয়েছে গঙ্গার বুকে।নতুন সূর্য আর ওঠেনি। আজও।
গল্প, উপন্যাস তাঁকে বানাতে হয়নি। কারণটা নিজেই বলেছেন মনোরঞ্জন। নিজের জীবনের এক একটা অংশই তো তাঁর এক একটা গল্প হয়ে উঠেছে। উঠে এসেছে উপন্যাসের একের পর এক চরিত্র। কিন্তু পাঠক সমাদরে এইসব কিছুকে ছাপিয়ে গেল তাঁর আত্মজীবনী ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন ।
নকশালদের জেল ভাঙার ঘটনা, রোজনামচা, গরাদের ওপারের মানুষদের নানা অভিজ্ঞতায় মুদ্রিত হয়েছিল বাতাসে বারুদের গন্ধ। ঝুলিতে এতদিনে পনেরোটা উপন্যাস।শ’দেড়েক গল্প।আত্মজিবনীর ইংরাজী অনুবাদ।এক ঝাঁক জাতীয় পুরস্কার।দেশের বিভিন্ন প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে সাম্মানিক বক্তৃতা। জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বক্তা। বলিউডে বায়োপিক –এর আবেদন। তবুও মনোরঞ্জন এগিয়ে চলেছেন।
বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে হেলেন কেলার বধির স্কুলে রান্নার কাজে নিযুক্ত। কথা মত কথা রাখেননি কেউই।পাঠক কি ভুলে গেলেন বইয়ের পৃষ্ঠায় বারুদ তৈরির জ্যান্ত কারিগরকে?বর্তমান সরকার কথা দিয়েও উপেক্ষা করেছেন তাঁর স্বাভাবিক কিছু চাওয়া পাওয়া।
রোজ দু’বেলা ১৫০ জন করে মোট ৩০০ জনের রান্নার যোগাড় করেন একার হাতে। চোখে কালি, রক্তে উচ্চচাপ ও শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি। পেরে উঠছেন না তিনি। শরীর কমিয়েছে লেখনীর ধার।
তাঁর লেখা নিয়ে প্রশংসা শুনতে আসেননি তিনি। তিনি এসেছেন ভিতরের কথা বলতে। জাতপাতের বেড়াজাল ছিন্ন করতে। নিজেকে মনে করেন খেলোয়াড়। এসেছেন পিছিয়ে পড়া দলিত শ্রেণীর মানুষকে উল্গুলানের কথা বলতে। তাদের অধিকারের কথা বলতে।
বিমানেই চড়ুন আর ট্রেনেই চড়ুন, সর্বক্ষণের সঙ্গী গামছা।গলায় ঝোলানো সেই গামছাই তাঁর আত্মজ। রক্তের ঘাম চুইয়ে পড়ে সেখান থেকে।কারণ শিকড়কে ধরে রাখার তীব্র আকাঙ্খা। এই ভদ্দরলোক বাবুদের মাঝে নিজের লড়াইয়ের কথা যাতে ভুলে না যান। গামছাই তাঁর লড়াইয়ের প্রতীক।