১৯৩৮-এর ১৫ জানুয়ারী বাংলাদেশের কিশােরগঞ্জে জন্ম হয় সুবিমল গােস্বামীর। ময়দানের চুনীর। ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে এমন 'অলরাউন্ডার' সম্ভবত আর পাওয়া যাবে না। দেশের ইতিহাসে সম্ভবত সেরা ফরোয়ার্ড।
১৯৬২-তে তিনি তখন হায়দরাবাদে। একই সঙ্গে আইএফএ এবং সিএবি থেকে টেলিগ্রাম পেলেন। দু'টি রাজ্য দলেই তিনি সুযোগ পেয়েছেন। যোগ দিতে হবে। শুনলে অনেকে অবাক হয়ে যেতে পারেন, তিনি ক্রিকেট দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভা বিরল! মাত্র নবছর বয়সে যোগ দেন মোহনবাগান জুনিয়র টিমে। আজীবন মোহনবাগানেই থেকে গিয়েছেন। শোনা যায়, জে সি গুহ ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ষাটের দশকের হার্টথ্রব ফিয়েট গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। তাতেও টোলানো যায়নি চুনীকে।
প্রথম মোহনবাগান জার্সি গায়ে ওঠে ভাগ্যের জোরে। দুজন অনুপস্থিত থাকায় জার্সি পেয়েছিলেন, চুনী খেলতে শুরু করলেন ইনসাইড-লেফ্ট হিসেবে এবং শুরু হল এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই এই রত্নকে চিনে ফেলেছিলেন ১৯১১-র শিল্ড-জয়ী দলের অন্যতম ফুটবলার বলাই দাস চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪৬-৫৪ পর্যন্ত সুবিমল মােহনবাগানের জুনিয়র দলে খেলেছেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত এই ১৪ বছর সময় সুবিমলের চুনি হয়ে ওঠার গল্প বলে। এই সময় তিনি মােহনবাগান দলে খেলেছেন। ৬০-৬৪ পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করেছেন। আবার ৫৬-৬৪ পর্যন্ত খেলেছেন ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে।
খেলােয়াড়ি জীবনে গুরুর ভূমিকায় পেয়েছিলেন বাঘা সােমের মত কিংবদন্তিকে। তীর্থপতি ইনস্টিটিউশন থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল মােহনবাগানের চুনির, দীর্ঘ ২২ বছরের ফুটবল জীবনে সেই ক্লাব তিনি কোনওদিনও ছাড়েননি। টটেনহ্যাম হটস্পার মতো ক্লাবের প্রস্তাবকেও হেলায় উপেক্ষা করেছেন। সেই সময়ে টটেনহ্যাম ছিল লন্ডনের সেরা দল এবং তাদের ম্যানেজার ছিলেন কিংবদন্তি বিল নিকোলসন। সবুজ মেরুন জার্সিতে ২০০ গােল করেছেন চুনী গােস্বামী। স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা চুনির ড্রিবেল ছিল চোখ ধাঁধানাে। ময়দানে বলের সঙ্গে সঙ্গে চুনির সঙ্গে ছুটত ভক্তদের হৃদয়। সন্তোষ ট্রফিতে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ২৫ টি গােল, অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস্ ও এশিয়া কাপে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়াডে তাঁর নেতৃত্বে সােনাজয়ী হয় ভারত। ১৯৬৪ তে এশিয়া কাপ এবং মার্ডেকা কাপে তাঁর নেতৃত্বে দ্বিতীয় স্থানে শেষ করে ভারত, ৪৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৩ টি গােল করেছেন। মোহনবাগান টানা তিন বার ডুরান্ড কাপ জেতে তাঁর নেতৃত্বে। পনেরো বছর মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। ছ'টি ডুরান্ড এবং দশ বার কলকাতা লিগ জয়ী দলের সদস্য তিনি। ১৯৫৫-য় সন্তোষ ট্রফিতে মহীশূরের বিরুদ্ধে বাংলার হয়ে জয়সূচক গোল করেন পি কে। সেই গোলটি ছিল চুনীর থ্রু পাস থেকে। বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে পিকে-চুনী-বলরাম সেরা তিন রত্ন। ত্রয়ীর দু'জন চলে গিয়েছেন খুব কাছাকাছি সময়ে। ১৯৫৬ অলিম্পিক্সে উপেক্ষিত হলেও দ্রুতই টোকিয়ো এশিয়ান গেমসে দলে জায়গা করে নেন। তার পরে আর কেউ তাঁর ফুটবল দক্ষতা অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায়নি। জাকার্তায় ১৯৬২ এশিয়ান গেমসে ভারতীয় ফুটবল দল সোনা জেতে তাঁরই নেতৃত্বে। সম্ভবত চুনীর ফুটবলজীবনে সেরা প্রাপ্তি। ১৯৬৪ এশিয়ান কাপ এবং মারডেকা টুর্নামেন্টে রানার্স দলের নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। এরপর ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে মনােনিবেশ করেন চুন৷ তবে ফুটবলেরও আগে বাংলার হয়ে ক্রিকেট খেলেন তিনি। ১৯৫২-৫৩ মরসুমে স্কুল ক্রিকেটে।
১৯৬২ থেকে প্রায় এক দশক বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলেছেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেনিস দলের সদস্য থাকার পাশাপাশি হকিও খেলেছেন। রঞ্জি মরসুমে একবার অধিনায়কত্বও সামলেছেন বাংলার। দু'দুবার দলকে ফাইনালে তুলেছেন। ডান হাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন চুনি সাথে করতেন মিডিয়াম স্পেস বল। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর সংগ্রহে ছিল একটি শতরান ও ৭ টি অর্ধ-শতরান সহ ১৫৯২ রান এবং ৪৭টি উইকেট। বিশ্ব ত্রাস লয়েডের ওযেস্টইন্ডিস-কে নতিস্বীকার করিযেছিলেন মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের যৌথ দলের সঙ্গে খেলায়। ক্যারাবিয়ান বিক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেদিন। তাঁর শ্রেষ্ঠ বােলিং প্রদর্শন ছিল ৪৭ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট।
সমগ্র ভারতে তিনি-ই একমাত্র ক্রীড়াবিদ যে সন্তোষ ট্রফি এবং রঞ্জি ট্রফি দুটি রাজ্য টুর্নামেন্টেরই অধিনায়কত্ব করেছেন। সন্তোষ ট্রফি জেতা হলেও রঞ্জিতে ছিলেন বিজিত। ১৯৭২-৭৩ মরশুমে ক্রিকেটকে বিদায় জানান চুনি। কোচিং-এ সেভাবে তিনি কোনােদিনই আসেননি। নিজেকে ময়দানের শ্রমিক ভাবতেন তাই গড়তে চেয়েছেন খেলােয়াড়। অধিকর্তার গুরুদ্বায়িত্ব সামলেছেন টাটা ফুটবল একাডেমির ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯, ৬৩ তে অর্জুন পুরষ্কার ৮৩ তে পদ্মশ্রী এবং ২০০৫ এ মােহনবাগান রত্নতে ভূষিত হন মােহনবাগানের এই ঘরের ছেলে। ২০০৫-এ হয়েছিলেন কলকাতার শেরিফ।
শুধু ক্রীড়া জগতেই থেমে থাকেননি তিনি। রুপােলী পর্দায় তাঁর একমাত্র অভিনয় করা সিনেমাটি হল 'প্রথম প্রেম' যা বানিজ্যিকভাবেও সফল। ভারতীয় ফুটবলের 'গ্ল্যামার বয়' ছিলেন চুনী। সব সময় নিজেকে সুসজ্জিত রাখতে পছন্দ করতেন। সাউথ ক্লাবে এখনকার দিনে খেললে নিঃসন্দেহে খেলার দুনিয়ায় লগ্নিকারীদের বিশেষ নজরে থাকতেন। উত্তমকুমার, হেমন্ত, এস ডি বর্মণ থেকে শুরু করে দিলীপকুমার, প্রাণের মতো তারকারা তাঁর ফুটবলের ভক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কও ছিল। এই বর্ণময় জীবন ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর আত্মজীবনী 'খেলতে খেলতে' ভারতীয় ক্রীড়া সাহিত্যে সত্যিই এক রত্ন।
এইরকম কিংবদন্তী শতাব্দীতে এক আধটাই জন্মায়। নেপথ্য নায়ককে প্রচারের আলােতে কেউই খুব একটা দেখেনি। বাংলার ক্রীড়া জগতের মুকুটহীন সম্রাটের জীবন অস্ত গিয়েছিল এপ্রিলে। বাঙালির হৃদয়ে রয়ে গেল মিড ফিল্ড থেকে উঠে আসা ড্রিবল করতে করতে সেন্টার ফরওয়ার্ডের দিকে বল বাড়িয়ে দেওয়া তরুন চুনী, বা স্ট্রাইকার হয়ে শত্রুপক্ষের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স ভাঙা চুনী। তাঁর দুর্ধর্ষ গতি এবং ড্রিবলিংয়ের সামনে নতজানু হতে দেখা গিয়েছে অনেক বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারকে। সঙ্গে দুরন্ত ট্র্যাপিং, সুচতুর পাসিং। কেউ কেউ মনে করেন, সেই সময়ে চুনীর ড্রিবলিং ছিল ব্রাজিলীয় কিংবদন্তিদের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি চলে গেলেও অমর হয়ে থাকবে ভয়ডরহীন সেই লড়াই! ময়দানের সত্যিকারের রত্ন ময়দানের কিংবদন্তির মহাপ্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে বাংলার ক্রীড়া ক্ষেত্রের সোনালী ইতিহাস।