পরনে আটপৌরে দক্ষিনী শাড়ি। কপালে মেরুন টিপের কয়েন। চোখে চশমা। ‘হাস্কি’ গলা আর ঝকঝকে হাসি। চলনে-বলনে তিনি সদা ‘পজিটিভ’। কেউ কখনও তাঁকে মুষড়ে থাকতে দেখেনি। তাঁর লিখনের মতোই। আপাদমস্তক ভয়ডরহীন মানুষ।
যদিও দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু সপ্রতিভ সাহস চমকে দেওয়ার মতই। সেই সাহস যে কতবার দুঃসাহস হয়ে, চমক দিয়েছে বড় বড় পালোয়ান সাহসীকে তার কাহিনী লিখেছেন নিজের কলমেও। তিনি নবনীতা। পুরো নামে "নবনীতা দেবসেন"।
তবে মা রাধারানী দেবীর কাছে তিনি চিরকালের শিশু। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপিকা বা লেখিকা নন, কোলের কাছটি জুড়ে থাকা একরত্তি কন্যা ‘খুকু’। নিজের অন্তরেও তেমনটিই ছিলেন নবনীতা। যার বয়স বাড়েনি কোনওদিন। ভালোবাসতেন রূপকথা। মায়ের মুখে যে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায় তেমন গল্প।
নবনীতার শৈশব শুরু হয়েছিল রূপকথার গল্পে। মা রাধারাণী দেবী রুপকথার গল্প শোনাতেন পৌত্রীদের। তাঁর রূপকথার কাহিনী লেখার শুরুও সেইভাবেই। মায়ের গল্প খুব ভালোবাসতেন। মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শৈশবের রূপকথারা প্রাজ্ঞ বয়সেও জল পেয়েছিল মায়ের সোনার কাঠির ছোঁয়ায়।
তিনি নিজেও রূপকথার কাহিনী লিখতে শুরু করেছিলেন কিছুটা যেন উত্তরাধিকার টানে।
খুদে কন্যাদের, পৌত্রীদের, খাওয়াতে গিয়ে ঘুম পড়াতে গিয়ে বা নিছক খেলার ছলে ‘বানিয়ে- বানিয়ে’ কথা সেসব। কথা জুড়ে জুড়ে ডানা মেলে গল্পের পক্ষীরাজ। শুকশারী। রাজা, রানী, রাজকন্যেরা। কিন্তু তারা কেউ অলীকপুরীর অলীক চরিত্র নয়। তারা রক্ত মাংসের। তারা হাসে। কাঁদে। কষ্ট পায়। বিপদে পড়ে। আবার বুদ্ধির জোরে খুঁজেও নেয় উদ্ধারের পথ।
নবনীতার রূপকথা শুধু কাহিনী শোনায় না। শোনায় ভালোবাসার কথা। হিংসা, রক্তপাতের বিরুদ্ধে নরম আলোর এক পৃথিবী। যেখানে বনের পশু আর মানুষ পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকে।
তাঁর ব্যক্তিগত দর্শন, জীবনের ওঠাপড়া, বাস্তববোধ, রক্তপাত আর যুদ্ধজয়ের কাহিনী মিলেমিশে থাকত রূপকথার শরীরে। তাই গল্প যত এগোয় তত মনে হয় কাহিনীর চরিত্ররা বড্ড চেনা। এই তো যেন ঠিক পাশের বাড়ি ছেলেটা, বা কোথায় যেন দেখেছি তাদের।
তাঁর নিজের কথায়, "আমার রূপকথায় একটু নারী শক্তির প্রকাশ আছে। রাজা, রাজপুত্তুররা আর নায়ক নন, ভুলভ্রান্তি ভরা সাধারণ মানুষ। রানিরা আর রাজকন্যেরা দুর্বল নন, অসহায় নন, তাঁরাই সক্ষম। বিপন্ন হলে উদ্ধারের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারেন। নিঃসন্দেহে তাঁরাই নায়ক"।
নবনীতার রাজকন্যারা শত্রুজয় করেন বাহুবলে নয়, বুদ্ধিবলে। নারীপুরুষের মধ্যে বৈষম্য ঘোচাতে এই দৃষ্টিভঙ্গী ভীষণ জরুরী। সমাজে ছেলেমেয়েরা সমান সম্মান পাক। আধুনিক সময়ের মুক্ত বোধগুলো যাতে ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে ডানা সেই ভাবনার বীজ ঘুমিয়ে ছিল প্রতিটা গল্পের গর্ভে।
বাস্তব যখন ক্রমশ আগ্রাসী ভঙ্গীতে গিলে খেতে চায় শৈশব, যা কিছু কোমল তখন স্নিগ্ধতায় জাগিয়ে রাখে তাঁর কলম।
কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"।
ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে। এই তিন মিলেই নবনীতার রূপকথা...