"এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় ভাই সবই হয় সব সত্যি সব সত্যি", সত্যিই এই দুনিয়ায় "কত কিছুই না ঘটে যাহা তাহা", সেরকমই একটি ঘটনার কথা বলি, যে ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের শহর কলকাতা। সময়টা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকের, সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা, এই তিনটি গ্রাম নিয়েই গড়ে ওঠে শহর কলকাতা। ১৬৫৮ সাল থেকে জোব চার্নক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী হিসেবে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সর্বেক্ষন করেন এবং বেশ কিছু অঞ্চলে কয়েকদিন করে বসবাস করেন। সুতানুটিকে স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য তিনি সুবিধাজনক মনে করেছিলেন বটে কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা এবং তাঁর ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সে কথা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু চট্টগ্রামে কোম্পানিকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হওয়ায় চার্ণক সুতানুটিতে বসতি স্থাপনের অনুমুতি পান। সুতানুটির অবস্থানগত নিরাপত্তার কারণে জোব চার্নক এই অঞ্চলকে বসতি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন। সুতানুটির পশ্চিম পাড় হুগলি নদী এবং দক্ষিণ আর পূর্ব দিকও ছিল বেশ দুর্গম, সেই কারণে কেবল উত্তরপূর্বে প্রহরীর ব্যবস্থা করলেই চলতো।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই তিনটি গ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল শাসকের অধীনে রাজত্বকারী বাংলার নবাবেরা| এই তিনটি গ্রামই ছিল বাংলার নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে| ১৬৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর, দিল্লী শাসন করছেন প্রথম বাহাদুর শাহ, বাংলার সুবেদার আজিমউসমানের নেতৃত্বে মাত্র ১৩০০টাকার বিনিময়ে কলকাতা সুতানুটি ও গোবিন্দপুর বিক্রি হয়ে গেল। সাবেক কলকাতার জায়গিরদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের থেকে গ্রাম তিনটি কিনে নিয়েছিলেন জোব চার্ণকের জামাতা ক্যাপ্টেন চার্লস। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন রায়চৌধুরীর পরিবার গ্রাম তিনটি প্রথমে বিক্রি করতে রাজি ছিলেননা, আপত্তিও জানান, কিন্তু আপত্তির কথা কানে তোলেননি আজিমউশমান, আজিমউশমানের পুত্র ফাররুকশিয়র ইংরেজদের থেকে ১৬০০০ টাকা উৎকোচ লাভ করার কারনেই হয়তো আজিমউশমানের এই আচরণ ছিল। নেহাত বিপাকে পড়েই রায়চৌধুরী পরিবার কলকাতাকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আজ ভাবলেই আশ্চর্য লাগে সেদিনের সেই তিনটি গ্রামই পরের শতকে হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর তথা ভারতের রাজধানী কলকাতা। যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সর্বাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিদ্বজনেরা প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের নিজ নিজ মাধ্যমে থেকে। শিক্ষিত সমাজ এই শহর থেকেই শিখেছিল কিভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার আস্বাদন পেতে হয়। আজ আমাদের গর্বের শহর কলকাতাকে সেলাম জানাতে হয়, তার সেই আদি পর্বের ইতিহাসের জন্য।