"ঘট"। দুটো বর্ণের একটি ছোট্ট শব্দ। "ঘট" বললে একটা ছবি ভেসে উঠে। দেব-দেবীর মূর্তির সামনে রাখা একটি ছোট আকারের কলসি। তার ভিতরে জল এবং বাইরে ফল-ফুল দিয়ে সাজানো হয়। অনেকে ঘটের গোলাকার অংশটিকে পৃথিবীরূপে কল্পনা করে থাকেন। আর তার আধার জল। পৃথিবীকে আমরা আবার মাতৃরূপেও কল্পনা করি। শষ্য শ্যামলা ধরিত্রী।
" বুদ্ধির ঘট নাড়া" এই কথাটি আমাদের সকলেরই কম-বেশি শোনা। অর্থাৎ বুদ্ধিকে শান দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ঘটের ভিতর জল অর্থাৎ মস্তকের ভেতর বুদ্ধিই অমৃতরূপে বিরাজমান। সেই অমৃতই সমস্ত সৃষ্টির মূলে।
মাটির তৈরি কলসজাতীয় পাত্র "ঘট" নামে পরিচিত। এখন অবশ্য পিতলের ঘটও পাওয়া যায়। "মঙ্গল ঘট", "মনসা ঘট", "নাগ ঘট", "লক্ষ্মীর ঘট", "কার্তিকের ভাঁড়, " দক্ষিণ রায়ের বারা" ইত্যাদি বিচিত্র ধরণের ঘট রয়েছে।
ঘট হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজো উপলক্ষে নির্মিত ও ব্যবহৃত হয়। "দুর্গাঘট" ছাড়াও বিভিন্ন ঘট আছে। "মনসার ঘট"-এ প্রতিমা বা ফনা মোটিফ হিসেবে থাকে। সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতিমা ও ধানছড়া অঙ্কিত ঘটকে "লক্ষ্মীর ঘট" বলে। ব্যাঘ্র দেবতার দক্ষিণারায়ের মুন্ড মূর্তির ঘট "দক্ষিণ রায়ের বারা" নামে পরিচিত।
ঘটে বিভিন্ন মটিফ আঁকা হয়। লোকশিল্পে মোটিফের ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোটিফ হল বাঙালির ঐতিহ্যাশ্রিত কতগুলি স্থায়ী ফর্ম বা ডিজাইন। যেগুলি নানা আঙ্গিকে ব্যবহৃত হয়। ধানছড়া, পদ্ম, স্বস্তিকার মোটিফ ঘটে বেশি দেখা যায়। "ধানছড়া" সমৃদ্ধির, "পদ্ম" পবিত্রতার এবং "স্বস্তিকা" সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হয়।
পূর্ণঘটের পুজোর মাধ্যমে দেব-দেবীকে আহ্বান করা হয়। ঘট হল ঈশ্বরের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। সেই কারণে ঘট স্থাপন করা প্রতি পুজোয় আবশ্যক। পুজোর সময় দেবতার সাকার এবং নিরাকার দুই রূপেরই পুজো করা হয়। তাই ঘট ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ।
ঘট স্থাপনের কিছু নিয়ম রয়েছে। ঘটকে মাটির তালের উপর বসাতে হয়। তাই কোন পবিত্র জলাশয়ের মাটি দরকার। এছাড়া ধান, জল, নবপত্রিকা, গোটা ফল, ফুলের মালা, সিঁদুর ও নতুন গামছা ঘটে দিতে হয়। ঘটে রাখা নবপত্রিকার প্রতিটি পাতায় সিঁদুরের টিপ আঁকতে হয়।
"প্রাণা হই প্রাণাঃ" মন্ত্র জপে দেবতার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার পর ঘটের ভিতরে দেবতার উদ্দেশ্যে জল দেওয়া হয়। জলভর্তি ঘট অন্তত একদিন নাড়ানো যায় না। ঘট নাড়িয়ে দেওয়ার অর্থ ঠাকুর বিসর্জন হয়ে যাওয়া। নরম মাটির তালের মধ্যে পঞ্চ শস্য দিয়ে তার উপর ঘট বসাতে হয়। এর অর্থ শষ্য- শ্যামলা পৃথিবীর মাঝে অভীষ্ট দেবতার অধিষ্ঠান।
ঋক, সাম ও যজু বেদ অনুসারে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে সামবেদ অনুসারে বেশি ঘট স্থাপন করা হয়ে থাকে। ঘট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গায়েত্রী জপ করতে হয়। পুজোর সময় যদি কোন কারণে ঘট হাত থেকে পড়ে যায় তাহলে ক্ষমা প্রার্থনা চাইতে হয়। তারপর আবার নতুন করে ঘট বসাতে হয়। পুজো শেষে ঘট বিসর্জন করার নিয়ম রয়েছে। ঘট বিসর্জন না দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন করা যায় না।
ঘট দেখে মনে হয় তৈরি করা খুব সহজ কিন্তু মোটেও তা নয়। ঘটের তলা থেকে মাঝের পেট মোটা অংশ এবং তারপরের সরু জায়গাটা একটানা করা সম্ভব। একেবারে উপরের চওড়া ঘোরানো অংশ তৈরি করা একটু কঠিন। সেটা আলাদা তৈরি করে নিচের অংশের সঙ্গে জোড়া দিতে হয়। শাস্ত্র মতে ঘটের উপরের অংশের সঙ্গে নিচের সংযোগ ঘটান সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা। মনে করা হয়, ব্রহ্মাণ্ডকে ঘটের আদলে তৈরি করেছেন ব্রহ্মা।
বর্তমানে পুজো ছাড়াও ঘট নানাবিধ কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ঘট রঙ করে ফুল পাতা বিভিন্ন মোটিফ বা ডিজাইনের মোড়কে এঁকে তা গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নগর-শহর-সভ্যতার কারুকার্য মেখে "ঘট"-এর আবেদন এখনও বহমান।