জাদুঘরের রূপকথা পর্ব ১

সময়টা ১৫৪১ সাল। সুলতান শের শাহ সুরি তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন অন্য একটি প্রদেশে। তখন মাধ্যম বলতে ছিল ঘোড়া অথবা পায়ে হেঁটে বার্তাবাহক-দূত। শেরশাহের দূত সাধারণত ব্যবহার করতেন বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। সেটাই ছিল সেই সময়ের তথ্য পৌঁছে দেওয়ার রাস্তা বা ইনফরমেশন হাইওয়ে।

একবার সেই রাস্তায় ভীষন দুর্যোগের মুখোমুখি হল দূত। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হল তাঁকে। ঘোড়া এবং বার্তাবাহক-দূত দুই ব্যবস্থাই ব্যর্থ হল।

তখন থেকেই সম্রাটের মাথায় চিন্তা ঘর বেঁধেছিল। কিসের চিন্তা? এমন কোন একটা ব্যবস্থা শুরু করতে হবে যা সকল দুর্যোগ পেরিয়েও বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। এভাবেই পোস্টাল সিস্টেম বা ডাক ব্যবস্থা নামে এক নস্ট্যালজিয়ার জন্মের গোড়াপত্তন হয়েছিল।

তারপর কালের স্রোত পেরিয়ে স্মৃতি, নস্ট্যালজিয়া বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে ডাক-ব্যবস্থা।

বিশেষ কোনো বছর, দিন বা কোন ব্যক্তিকে সম্মান জানাতে প্রকাশ করা হয় ডাক-টিকিট। ডাক-টিকিট জমানো নেশার মত। পোশাকি নাম ফিলাটেলি।

তখন ১৮৮৫ সাল। সেই সময় ভারতীয় পোস্ট-অফিসের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন ফ্রেডরিক রাসেল হগ। একবার পোস্ট অফিস সংক্রান্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ নথি তিনি পাচ্ছিলেন না। এদিকে এই নথি ছাড়া আটকে রয়েছে বেশ কিছু কাজ। তখনই তাঁর মাথায় এল এক অভিনব ব্যবস্থার কথা। সেই ব্যবস্থার নাম জাদুঘর বা সংগ্রহশালা। তৈরি হলো কলকাতার পোস্টাল মিউজিয়াম বা ডাক-জাদুঘর।

ভারতবর্ষে এটিই প্রথম এবং একমাত্র ডাক-জাদুঘর।

ঠিকানা নেতাজি সুভাষ রোড, কলকাতা-৭০০০০১।

কলকাতা পোস্ট অফিসের প্রধান বিল্ডিং -এর একেবারে নিচেই এই জাদুঘর।

PostalMuseum2

৭০০-৮০০ বর্গফিট জায়গা জুড়ে চারটি ঘর নিয়ে এই জাদুঘরের রূপকথা সেজেছে। তবে খুব সম্প্রতি এই জাদুঘরকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। সমস্ত পুরানো জিনিসে আরেকবার লেগেছে নতুনের পরত। ডিজিটাল ব্যবস্থা শুরু হয়েছে এখানে।

সপ্তাহে সাত দিনই সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত খোলা এই জাদুঘর।

ফটো তোলায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা যাবে না।

এই জাদুঘরে প্রবেশ করেই স্মৃতি-ভ্রমণে ভেসে যাওয়া যায়। প্রবেশ করেই সামনে বড় দালান। নানান পুরনো স্ট্যাম্প, পোস্টকার্ড, মানচিত্র, এমনকি ডাকঘরে টাকা জমানোর সার্টিফিকেট পর্যন্ত রাখা আছে এখানে।

এরপর আস্তে আস্তে স্মৃতির ছন্দে এই জাদুঘরের বাকি চারটে ঘরও ঘুরে দেখা যায়।

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামনের পোস্টাল সার্টিফিকেট দেখতে পাওয়া যায় এই জাদুঘরে।

কবিগুরুর সই সমেত তাঁর ডাকঘরের পাসবুক সযত্নে কাচের ঘরে রাখা রয়েছে।

এছাড়াও দুষ্প্রাপ্য সব ডাকটিকিটের সম্ভার নিমেষে মনকে পাড়ি দেওয়াবে অজানা, অলীক জগতে।

PostalMuseum3

বিবর্তন সবকিছুরই অঙ্গ। ছোটবেলার সেই খুচরো পয়সার স্মৃতিরা আজও বাতাসের মত বয়ে বেড়ায় চারিদিকে। সেইসব দুষ্প্রাপ্য পয়সা, গিণি সংগ্রহে রয়েছে এই ডাক-জাদুঘরের।

প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় ডাক ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দেওয়া হয়েছিল সাম্মানিক মেডেল। সেইসব চাক্ষুষ করা যায় এই জাদুঘরে।

হলুদ রঙের পোস্টকার্ডরা ঠিক যেন বিকেলের মত। স্মৃতি-গন্ধ নিয়ে তারা অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়ায় আমাদের অবচেতনে। যশস্বী ব্যক্তিদের স্মৃতি মাখানো পোস্টকার্ডও সংগ্রহে রয়েছে এই জাদুঘরের।

সেই সব স্মৃতিদের ধাওয়া করার ইচ্ছে হলে একবার ঢুঁ মেরে আসা যেতেই পারে কলকাতার ডাক-জাদুঘরে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...